শেষ ছোঁয়া
লেখিকা -- শ্বেতলীনা
ভোরবেলার এক টুকরো মিঠে রোদ সহেলীর মুখের ওপর এসে পড়ে মুখটা আরও নমনীয়
করে তুলছে। অবসন্ন চোখে সহেলী জানলা দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একদৃষ্টিতে যতদূর
যেতে পারে চলে যেতে চাইছে। দৃষ্টি দিয়েই ঘুরে আসতে চাইছে।রোগে ভোগা ফ্যাকাশে ক্ষীণ
শরীরে রোদ মেখে নিয়ে সতেজ হতে চাইছে। কোমর ছাপান চুলের এলোমেলো বিনুনিটা অনাদরে পিঠের
ওপর থেকে নেমে এসে বিছানায় লুটিয়ে আছে। দু’হাতের সরু সরু আঙুলগুলো একে অপরকে জড়িয়ে
ধরে আলগোছে কোলের উপর এলিয়ে আছে।
সকালের চা বানাতে বানাতে অর্ণব রান্নাঘর থেকে সহেলীকে দেখে একটু হালকা
নিঃশ্বাস ফেলে। মাত্র তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে ওদের।দু’জনেরই কর্ম ব্যস্ততাময় জীবনের
দেড় বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন সহেলী অজ্ঞান হয়ে গেল অফিসে। খবর পেয়েই ছুটে যায় অর্ণব।
তারপর গত দেড় বছর তাঁদের শুধুই কেটেছে হাসপাতাল আর বাড়ি করে। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর,
হাস্যোজ্জ্বল সহেলীর জীবন থমকে যায় সেই থেকে।দুরারোগ্য স্নায়বিক এক রোগ। যা ধীরে ধীরে
সহেলীকে করে দিয়েছে চলৎশক্তিরহিত। এখন শুধুই প্রতীক্ষা সেরে ওঠার।সেরে উঠতেই চায় সহেলী।
যদিও জানেনা আর কখনো সেরে উঠে আগের জীবন ফিরে পাবে কিনা।
অর্ণব চা নিয়ে এসে পাশে বসে। হাতে সকালে খাওয়ার জন্য কয়েকটা ওষুধ।ওষুধগুলো
হাতে নিয়ে ফিকে হাসে সহেলী। যেন বলতে চায় এই সম্বল এখন। সমস্ত স্বপ্নগুলো মুছে যাচ্ছে
যেন। কিন্তু কিছু না বলে ওষুধগুলো নিঃশব্দে গিলে ফেলে।
অর্ণব চা এগিয়ে দিয়ে একটু হেসে বলে –” আজ কি খেতে ইচ্ছা করছে বলো? যা
বলবে তাই বানাবো?নিজে বানাবো। মাসিকে আজ ছুটি দিয়েছি।আজ তোমার সাথে একা থাকতে ইচ্ছা
করলো, তাই।”
সহেলী চুপ থাকে।কি যেন ভাবে। বলে ওঠে – “আমাকে একবার সুবর্ণরেখা দেখাতে
নিয়ে যাবে?”
চমকে উঠে তাকায় অর্ণব।সহেলীর দু’চোখে তখন সুবর্ণরেখার ধারা।অর্ণবের
ছেলেবেলা কেটেছে রাঁচিতে। বাড়ির পাশেই সুবর্ণরেখা।সহেলী অনেক গল্প শুনেছে অর্ণবের কাছে।
স্থানীয় বিশ্বাস নদীর বালি থেকে সোনা পাওয়া যায়। কিন্তু সহেলী যেতে চায় অন্য কারণে।
অর্ণবের থেকে শোনা মায়াবী চাঁদের আলোতে ভেসে যাওয়া সুবর্ণরেখার তীরে গিয়ে বসতে চায়
সহেলী।অনেক বছর ধরেই যাওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি। এখন শরীরের এই অবস্থায় সহেলীর
পক্ষে এতদুর যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাও অর্ণব মাথা একদিকে কাত করে বলে, “ নিশ্চয়ই নিয়ে
যাব। একটু সেরে ওঠো, তারপর।“
“ না এখনি নিয়ে চল। কদিন ধরে খুব যেতে ইচ্ছা করছে।রাতের সুবর্ণরেখা
দেখতে ইচ্ছা করছে।তুমি বলেছিলে।“ জেদ করে সহেলী।
“ এখন তো তুমি যেতে পারবেনা।কষ্ট হবে যে।ক'দিন যাক, তারপর ঠিক নিয়ে যাব।“
অর্ণব বোঝাতে চায়।
“ আর দেরী করলে যদি যাওয়াই না হয়? চাঁদের আলোয় আমার আর তাহলে সুবর্ণরেখা
দেখা হবেনা। “ সহেলী মাথা ঘুরিয়ে জানলার বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়।
অর্ণব নিরুত্তর থাকে। জবাব হাতড়াতে হাতড়াতে সামাল দিতে থাকে বুকে ওঠা
প্রবল ঝড়কে।অতি কষ্টে জবাব দেয়,”তা কেন? ঠিক নিয়ে যাব তোমায়।“
সহেলী নিজের মনেই বলে ওঠে,” চাঁদের আলোয় চারিদিক ভরে থাকবে। নদী তীরের
বালিতে চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করবে। জলের মৃদু আওয়াজ যেন আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যাবে।
আমি আর তুমি পাশাপাশি বসে থাকব। নদীর থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের মন শান্ত করে
দেবে। তোমার কাঁধে মাথা দিয়ে আমার চোখ বুজে আসবে। তুমি ভরাট গলায় গাইবে।তোমার গান চারিদিকে
ছড়িয়ে পড়বে। আমি শুনেই যাব। তুমি গেয়েই যাবে। কতদিন তোমার গান শুনিনি। নিয়ে চল আমায়।
নদী যেন ডাকছে আমায়।“
***
তিন বছর পর। অর্ণব বসে আছে সুবর্ণরেখার তীরে।তিন বছর আগে আজকের রাতে
সুবর্ণরেখার তীরে চাঁদের আলো গায়ে মেখে,নদীর কলতানে খুশি হয়ে, অর্ণবের কোলে মাথা রেখে
গান শুনতে শুনতে মুগ্ধ সহেলী ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ঘুম আর ভাঙ্গেনি। অর্ণব প্রতিবছর এই
দিনে নদীর তীরে ফিরে ফিরে আসে। প্রিয়তমার শেষ মুহূর্তের ছোঁয়া পাওয়ার আশায়।
চিত্র সৌজন্যঃ https://anime.goodfon.com