শিশুদের সুখাদ্যাভ্যাস তৈরির কৌশল
বর্তমানের
ব্যস্ততাময় সময়ে শিশুদের ছোট ছোট বিষয়গুলো অনেক সময় বড় সমস্যা তৈরি করে। ইদানিং কালের
বেশিরভাগ শিশুরই একটি সাধারণ সমস্যা হল খাবার গ্রহনে অনিহা বা অনেক শিশু বাজারজাত মুখরোচক
খাবারে আকৃষ্ট হয় বেশি। বাবা- মায়েরা শিশু সন্তানের খাবারের বিষয়ে অনেক সময়েই নাজেহাল
হয়ে যান । কোন খাবার তাঁদের জন্য ভালো আর কোনটা ক্ষতিকর, তা বুঝে ওঠার সাথে সাথে কিভাবে
একজন শিশু প্রতিদিন সুষম পুষ্টি গ্রহন করতে পারবে তা বোঝা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে।স্বাভাবিক
ভাবেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর পুষ্টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।শিশুর এক বছর থেকে শুরু করে
বৃদ্ধির বিভিন্ন ধাপে খাদ্যরুচির পরিবর্তন ঘটে। প্রতিটি শিশুর আহারের পছন্দ ও অপছন্দ
বিভিন্ন হওয়ায় তাদের সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পৃথক পন্থা অবলম্বন করা হয়।
কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করলে শিশুর সুখাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব।সুষম ও স্বাস্থ্যকর
খাদ্যের সাথে সাথে খাবার যেন স্বাদু হয় সেদিকেও নজর রাখা জরুরি।
·
প্রথমেই
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে জানতে হবে শিশুর বয়েস ও ওজন অনুপাতে কোন ধরনের খাবার কত পরিমানে
তার উপযোগী হবে।প্রতিদিন পরিমাণমত জল যেন শিশু গ্রহন করে তার দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত
প্রয়োজনীয়।
ছবি সৌজন্যঃ stock.adobe
·
বাড়ির
সবার সাথে বাচ্চাকে খেতে দেওয়া উচিত। সাধারণত বাচ্চারা বড়দের নকল করতে ভালবাসে। তাই
বাবা-মা বা বাড়ির অন্যরা একসাথে খেলে বাচ্চার নিজের খাওয়ার ইচ্ছা তৈরি হয়। একসাথে সবার
সাথে খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে করতে খাওয়া অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়।
·
বাচ্চাকে
যা খাবার দেওয়া হবে সেই খাবার বড়রাও যেন খান। একই খাবার খেতে দেখলে শিশুমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া
তৈরি হয়না। নিজের খাবার আলাদা দেখলে সাধারণত বাচ্চার খাবারে অনিহা হয়।বাবা – মা স্বাস্থ্যকর
খাদ্য গ্রহন করলে শিশুও স্বাভাবিকভাবেই তা গ্রহন করতে শিখবে। তাই নিজেকে উদাহরণ স্বরূপ
পেশ করার চেষ্টা করা উচিত।
·
ভাজা,
তৈলাক্ত, মশলাদার খাবার না দেওয়াই উচিত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে শিশুখাদ্য বিস্বাদ
হবে।স্বাদু করতে নুন ও মিষ্টির সঠিক সংমিশ্রণ দিয়ে খাবার দিতে হবে।
·
খাবার
দেখতে যেন সুন্দর হয়। সাধারণত শিশু খাবারের ক্ষেত্রে আমরা এই বিষয়টি বাদ দিয়ে যাই।
খাবার যদি আকর্ষণীয় দেখতে হয় তাহলে বাচ্চা খুশি মনে খাবে।বিভিন্ন স্বাদের ও বর্ণের ফল, সব্জী প্রভৃতি মিশিয়ে খাবার দিলে শিশু খুশি মনে তা গ্রহন করবে।
·
খাবারে
সব্জি, ফল, দুগ্ধজাত খাবার, প্রোটিন, ভিটামিন প্রভৃতি সব কিছুই সঠিক পরিমানে থাকা আবশ্যক।স্বাদু
খাবারের সাথে সাথে খাবার যেন শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পূরণ করতে পারে তার দিকে নজর দেওয়া
দরকার।
· রোজ
স্বাদ বদলের জন্য নতুন খাবার দিতে হবে। একই খাবার রোজ খেলে মুখে অরুচি আসতে বাধ্য।গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ১৫ - ২০ বার একটি নতুন খাবার অপছন্দ করার পর শিশু সেটি গ্রহন করে। তাই রোজ পৃথক খাবার দিলে তার গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে।
·
খাওয়ার
সময় টিভি, ফোন প্রভৃতি চালিয়ে কার্টুন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি দেখিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা একেবারেই
করা উচিত না।বরং কথা বলে বা অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করে খাওয়ানো উচিত। হতে পারে এগুলো
কঠিন ও সময়সাধ্য উপায়, কিন্তু লাভজনক।চিকিৎসকরা মনে করেন টিভি, ফোন প্রভৃতির সাহায্য
নিয়ে খাওয়ালে শিশুর পুষ্টি অপূর্ণ থেকে যায়। সাথে খারাপ অভ্যাস তৈরি হয়।
·
কিছু বাচ্চা খাবারে প্রবল অনীহা থাকে। খিদা না পাওয়া
এক্ষেত্রে একটি বড় ব্যাপার। তাদের খাবারের সময়ের মধ্যে বেশি ফাঁক দিতে হবে, যাতে আগের
খাবার হজম হওয়ার সময় পায়। সঠিকভাবে খাবার হজম হলে শিশু নিজে থেকেই খাবে।
·
একটু বড় হলে, প্রায় ৬/৭ বছরের শিশুকে বাজারে নিয়ে
গিয়ে সব্জী, ফল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সাথে পরিচিত করানোর সাথে সাথে খাবারের পুষ্টিগুণ
ও উপকারীতা বলে দিলে শিশুমনে তা রেখাপাত করে। শিশু নিজেই স্বাস্থ্যকর খাবারে প্রতি
আগ্রহী হয় ।
·
বাজারজাত
খাবার যেমন চিপস, চানাচুর, বিভিন্ন রঙিন পানীয় প্রভৃতির ক্ষতিকর দিকগুলোও বলা ও বোঝানো
উচিত। এর ফলে অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি শিশুর অনিচ্ছা তৈরি হয়।
·
খাবার
তৈরির সময় শিশুকে সঙ্গী করলে খাবার খাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। যখন খাবার তৈরি করা হয় সেই
সময় ছোট ছোট ব্যপারে শিশুকে সঙ্গী করলে, নিজের তৈরি খাবারের প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই
আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। তারমানে এই নয় যে শিশুকে দিয়ে সব্জী কাটাতে হবে বা রান্না করাতে
হবে। কখনই নয়। কিন্তু রসুন ছাড়ানো, শাকের পাতা বাছা, সেদ্ধ ডিম বা আলুর খোসা ছাড়ানোর
মত নিরীহ কাজ করালে বাচ্চারা খুশিও হয় এবং খাবার গ্রহনে আগ্রহ তৈরি হয়।
·
জোর
করে খাওয়ানোর চেষ্টা না করাই উচিত। বেশিরভাগ
বাবা- মা শিশুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টার ফলে ছোট থেকেই শিশুর মনে খাবার
গ্রহন সম্পর্কে এক ধরনের বিরক্তি ও ভয় সৃষ্টি হয়।ফলে খাদ্য গ্রহনে অনীহা হয়। খিদে পেলে
বাচ্চা নিজে থেকে খাবে – এই কথা মাথায় রাখা উচিত।
· খাবার
অল্প পরিমানে বারে বারে দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। অল্প খাবার হজম করতে সুবিধা হয়। খাবার
হজম হয়ে গেলে শিশু নিজে থেকেই খাবার খেতে চাইবে।সারাদিনে পাঁচ থেকে ছয়বার খাবার গ্রহনের
সময় ভাগ করে নিতে হবে। এঁর মধ্যে দুবার হালকা খাবার যেমন বিস্কুট, ঘরে তৈরি কেক, ফলের
রস প্রভৃতি খেতে দিতে হবে।
·
শিশুকে
নিজের ইচ্ছা মত খাবার পছন্দ করতে দিলে ভালো হয়।অবশ্যই তার উপযোগী খাবারগুলির মধ্যে
তাকে পছন্দ করতে দিতে হবে। এঁর ফলেও শিশুর মধ্যে সুখ্যাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। আজ যে খাবার
তার পছন্দ হচ্ছেনা কাল ও যে তা অপছন্দ হবে তা নয়। বাচ্চাদের খাবারে রুচি ও পছন্দ প্রতিনিয়ত
পরিবর্তনশীল। তাই ধৈর্য ধরতে হবে।
·
কোনও
ভালো কাজের পুরস্কারস্বরূপ খাবার দেওয়া উচিত না। ভালো কাজ করলে উৎসাহ দিতে হবে, আদর
ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু তার জন্য তার পছন্দের খাবার দেওয়া একেবারেই ঠিক
নয়। এর ফলে বাচ্চার বেশি খাবার গ্রহনের প্রবণতা তৈরি হয়। পরিবারের সাথে মানসিক যোগাযোগ
কমে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
পরিশেষে
বলব শিশুর প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাবার গ্রহনের জন্য শিশুকে মানসিকভাবে বিকশিত হতে দিতে
হবে। পরিমাণে কম খেলেই যে পুষ্টিতে ঘাটতি থেকে যাবে এমন নয়। তাই জোর করে বা বল প্রয়োগ
করে , খাবার বেটে, জলে গুলে খাওয়ানোর চেষ্টা না করাই ভালো।এতে উপকারের ফলে অপকার বেশি
হয়। নিজের ইচ্ছায় খুশি মনে যতটুকু খাবার বাচ্চা
খাবে তাই খেতে দেওয়া উচিত। উচিত ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর সুখ্যাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
যায়।