দেওয়াল চিত্রকথা - ম্যুরাল



 কেরালার ম্যুরাল — "লক্ষ্মী-নারায়ন"

"ম্যুরাল" শব্দটির এক কথায় অর্থ হল " দেওয়াল চিত্র" বা " দেওয়াল অঙ্কন" ।"ম্যুরাল" শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ "মুরুস" থেকে, যার অর্থ দেওয়াল (wall) ।

ম্যুরাল হল এমন এক চিত্রকলা, যা দেওয়াল, ছাদ বা অন্যান্য স্থায়ী পৃষ্ঠতলগুলিতে আঁকা হয় বা সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। ম্যুরাল চিত্রকলার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল প্রদত্ত স্থানটির স্থাপত্য উপাদানগুলি সাদৃশ্যপূর্ণভাবে ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাধারনত দেওয়ালে সরাসরি অঙ্কিত চিত্রকলাকে ম্যুরাল বলা হলেও, ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বড় ক্যানভাসে চিত্র অঙ্কন করে পরে তা দেওয়ালে প্লাস্টার বা সিমেন্টের সাহায্যে স্থায়ীভাবে জুড়ে পরপর সংযুক্ত করা হয়, এই কৌশলকে "ম্যারোফ্লেজ" ( Marouflage) বলে।

ইতিহাসঃ

প্রাগৈতিহাসিক সময়ে গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যা বর্তমানকালে ম্যুরাল চিত্রকলার পূর্বসূরিরূপে গন্য করা হয়। সেই সময় গুহাবাসী মানুষ পাথরের গায়ে আঁচড় কেটে বা খোদাই করে নিজেদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে গেছেন যা ইতিহাসের এক অমুল্য সম্পদ। এই সমস্ত গুহাচিত্র থেকে সেই সময়কার দৈনন্দিন জীবনশৈলী, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতির সম্পর্কে বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য থেকে ভিন্ন ভিন্ন যুগের সম্বন্ধে আমরা ধারনা পেয়ে থাকি।

এখনও পর্যন্ত যত দেওয়াল চিত্র পাওয়া গেছে তাদের সময়কাল হিসাব করে দেখা গেছে যে প্রস্তরযুগের অন্তিম সময় থেকে এর অস্তিত্ব ছিল।

যেমন বোর্নিওর লুবাং জেরিজি সালেহ গুহার দেওয়ালে ৪০,০০০-৫২,০০০ বছর আগের গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। এই গুহাচিত্রটি ( বলদে আকৃতি) এখনও অবধি প্রাপ্ত ম্যুরালের মধ্যে প্রাচীনতম হিসাবে ধরা হয়।

দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্ডেশ বিভাগের শভেট গুহার চিত্র ( এক দল গণ্ডার) প্রায় ৩২০০০ বছর আগের।

প্রায় ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরের সমাধির মধ্যে অনেক প্রাচীন ম্যুরাল পাওয়া গেছে।

ফ্যারাও তুতেনখামেনের সমাধিতে প্রাপ্ত দেওয়ালচিত্র।

এছাড়াও মধ্যযুগে তৃতীয় ১৭০০–১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) মিনোয়ান রাজবাড়ীতে ,অক্সটোশিটলান গুহায় চিত্র পাওয়া গেছে।

প্রায় ১২০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেক্সিকোর জুক্সটলাহুয়াকা পাওয়া ম্যুরাল।

রোমান সভ্যতায় ম্যুরাল এক অন্যমাত্রা যোগ করে। সেই যুগের সমস্ত স্থাপত্যে এই চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষত পম্পেই এবং অষ্টিয়ার সমস্ত ভবনে প্রাকৃতিক, স্থির জীবন ও মূর্ত দৃশ্যাবলীর অপরূপ সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। পম্পেই-এর কাসা-দে-কাস্তি-আমান্তিতে(Casa dei Casti Amanti) প্রায় ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে – ৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই ধরনের ম্যুরাল পাওয়া গেছে।

রেনেসাঁ যুগে ম্যুরাল চিত্রকলার বিশেষ বিস্তার ঘটে। শিল্পবোদ্ধারা এই চিত্রকলার প্রসারের জন্য বিশেষ উৎসাহী ছিলেন এবং ব্যয় করতেও পিছপা হতেন না।

প্রাচীন ভারতেও এই চিত্রকলার নিদর্শন আমরা দেখতে পাই অজন্তা গুহাচিত্রে।

 অজন্তা গুহার দেওয়াল ও ছাদে রচিত ম্যুরাল চিত্রকলা।

পরবর্তীকালে মেক্সিকান শিল্প আন্দোলনের সময় মেক্সিকান ম্যুরালিজমকে লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চি ও মাইকেলএঞ্জেলোর মত জগত বিখ্যাত শিল্পীরা বিশেষভাবে প্রসারিত করেন।সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবধারা প্রচার করতে সেই সময় ম্যুরাল বিশেষ ভুমিকা পালন করে। "দ্য গ্রেট থ্রী" - দিয়েগো রিভিয়েরা, জোশ ক্লিমেন্ট অরোসকো ও ডেভিড আলফারো সিকিওরোস এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন।

প্রযুক্তিঃ

অঙ্কনের বহু শৈলী ও কৌশল আছে।যেমন —

১৬০০ খ্রী মেল্ক আব্বে-র এক ছাদে আঁকা ফ্রেস্ক

ফ্রেস্কো -

ইতালিয়ান শব্দ এফ্রেসস্কো থেকে যা ফ্রেস্কো শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ "তাজা"। এই পদ্ধতিতে দেওয়াল বা ছাদের [প্লাস্টারের উপর রং প্রয়োগ করা হয়।সর্বাধিক ব্যবহৃত ফ্রেস্কো পদ্ধতিতে ভিজে লাইমওয়াশের সঙ্গে জলে দ্রবণীয় রঙ ব্যবহার করা হয়, এই দ্রবনটি খুব তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ পৃষ্ঠতলে লাগিয়ে নেওয়া হয়, অথবা কখনো কখনো কিছু অংশে লাগানো হয়। শুকিয়ে গেলে রং হালকা হয়ে যায়।

ম্যান্টুয়ার প্যালাজ্জো ডেল টে - তে আঁকা গ্যালিলিও রোমানোর বুয়েন ফ্রেস্কো চিত্র

বুয়েনফ্রেস্কো পদ্ধতিতে রঙ জলে ভিজিয়ে, সিক্ত, টাটকা পাতলা লাইম মর্টার অথবা প্লাস্টারে লাগানো হয়।রঙ ভিজে প্লাস্টার দ্বারা শোষিত হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে, প্লাস্টার শুকিয়ে যায় এবং বায়ুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে: এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে রঙ প্লাস্টারের সঙ্গে আটকে যায়। এর ফলে চিত্রটি উজ্জ্বল এবং চমৎকার রং নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত থাকে।ষোড়শ শতকের শেষ নাগাদ "বুয়ন ফ্রেস্কো" পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহার হতে থাকে, এবং গিয়ানব্যাতিস্তা টাইপোলো ও মাইকেল এঞ্জেলোর মতো চিত্রশিল্পীরা এর বহুল ব্যবহার করেন।

জব্বলপুরের শহীদ স্মারকে আঁকা বেওহার রামমনোহর সিনহার আঁকা ফ্রেস্ক-সেকো

ফ্রেস্কো সেকো পদ্ধতিতে শুকনো প্লাস্টারের ওপর চিত্র করা হয়। ইতালিয় ভাষায় "সেকো" শব্দের অর্থ "শুষ্ক"। এই ক্ষেত্রে পিগমেন্টগুলির আটকে থাকার জন্য কিছু মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয় ডিম- রঙিন প্রলেপের জন্য, আঠা এবংতেল ।

মেজো-ফ্রেস্কো পদ্ধতিতে প্রায় শুকনো প্লাস্টারে চিত্র আঁকা হয়, ষোড়শ শতাব্দীর লেখক ইগনাজিও পজো যাকে বলেছেন যে "একটি অঙ্গুষ্ঠ ছাপ না পড়ার মত যথেষ্ট শক্ত"। এতে রঙ প্লাস্টারের মধ্যে সামান্যই ঢোকে।

থাইল্যান্ডের টেম্পেরা ম্যুরাল চিত্র

টেম্পেরা ম্যুরাল চিত্রের প্রাচীনতম পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি। টেম্পেরাতে রঙ জলে পাতলা করে নেওয়া জন্য কোন অ্যালবুমিন মাধ্যম যেমন ডিমের সাদা বা কুসুম অংশে মেশানো হয়।টেম্পেরা চিত্রের স্থায়িত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এর ব্যবহার বেশি হত। প্রায় ১৫০০ শতক অবধি এর ব্যবহার চলে আসার পর তৈল চিত্রের ব্যবহার শুরু হয়।

তাৎপর্যঃ

জনসাধারণের মধ্যে শিল্পচেতনা জাগ্রত করতে ম্যুরালগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা গ্রহন করে। একটি ম্যুরালের যে আকার হয়, এবং তা তৈরিতে যে খরচ এবং কার্যক্ষমতা লাগে তার জন্য কোন সাহায্যদাতা ছাড়া ম্যুরালশিল্পীদের কাজ করা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় সরকার, কোন ব্যবসা থেকে সাহায্য পাওয়া বা পৃষ্টপোষকদের সাহায্যে ম্যুরাল তৈরী করা হয়। শিল্পীরা বিস্তৃত পরিসরের সেই সব দর্শকদের কাছে তাঁদের কাজ নিয়ে যেতে পারেন, যাঁরা শিল্প গ্যালারীতে পা রাখেন না। শিল্পের সৌন্দর্য দ্বারা একটি শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়।একটি ম্যুরাল সামাজিক মুক্তির বা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের একটি অপেক্ষাকৃত কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে অনেক সময়েই ব্যবহার করা হয়। এই রকম প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হলেও তাদের এখনও কিছু শৈল্পিক মান আছে। লোকালয়ে ম্যুরাল লাগানো হলে পথচারীদের ওপর সচেতন বা অবচেতনভাবে ম্যুরালের একটি নাটকীয় প্রভাব পড়তে পারে।

অন্যান্য বিশ্বখ্যাত ম্যুরালগুলি মেক্সিকো, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, বেলফাস্ট, ডেরি, লস-অ্যাঞ্জেলেস, নিকারাগুয়া, কিউবা এবং ভারতে দেখতে পাওয়া যায়। দ্বন্ধের সময় এগুলি সামাজিক ও জাতিগতভাবে বিভক্ত সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে। এগুলি সংলাপ শুরু করা ও চালানোর জন্য একটি কার্যকর উপায় হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, অতএব বিভেদ মেটানোর এটি একটি সমাধান হতে পারে।

অনন্তশয্যায় বিষ্ণু

শিব তাণ্ডব ম্যুরাল চিত্র

ভারতের কেরলে কিছু বিশেষ রকম ম্যুরাল আছে। কেরলের মন্দিরের দেওয়ালে বিশেষ ধরনের ম্যুরাল চিত্র রয়েছে। সেগুলি খ্রিস্ট পরবর্তী নবম শতকের হতে পারে।

আয় বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে পর্যটন আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য অনেক গ্রামীণ শহর ম্যুরাল ব্যবহার শুরু করেছে। এমন একটি শহর হল ক্যালকিট, জর্জিয়া। ২০১০ এর গ্লোবাল ম্যুরাল কনফারেন্স আয়োজন করার জন্য ক্যালকিটকে নির্বাচন করা হয়েছিল। শহরে বারোটি ম্যুরাল তৈরী সম্পন্ন হয়েছে।

সম্প্রতি গ্রাফিতি এবং খোলা রাস্তায় এই শিল্প সমসাময়িক দেওয়াল চিত্রকলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।কিথ হ্যারিং, অ্যাবভ, সার্ফ ও ফেইলি প্রমুখ গ্রাফিতি শিল্পীরা শহুরে ভূদৃশ্য অতিক্রম করে, ব্যক্তিগত এবং কর্পোরেট খরিদ্দারের কাছে তাঁদের শিল্পকে সফলতার সঙ্গে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। গ্রাফিতি শিল্প ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে আরও মূলধারায় মিশে যাচ্ছিল। যুব-ভিত্তিক দল যেমন নাইকি এবং রেড বুল, উইডেন কেনেডি, গ্রাফিতি শিল্পীদের দিয়ে তাদের নিজ নিজ অফিসের দেওয়াল সাজিয়ে নিয়েছিল। এই প্রবণতা ২০০০ সাল জুড়ে অব্যাহত ছিল এবং গ্রাফিতি শিল্প বিশ্বব্যাপী শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে আরো স্বীকৃতি অর্জন করে।

ইদানিং পাথর, সিরামিক, চীনামাটির বাসন, গ্লাস এবং ধাতু দিয়ে তৈরী টালিগুলি বাড়ির ভিতর বা বাইরের দেওয়ালে বসিয়ে ম্যুরালে রূপান্তরিত করা হয়। এগুলি মেঝেতেও বিছানো চলে। ম্যুরাল টাইলগুলি সাধারণত আঁকা, গ্লেজড, পাথর থেকে টুকরো টুকরা বা ভাঙ্গা হয়।

মোজাইক ম্যুরালগুলি ছোট আকারের ১/৪" থেকে ২" আকারের রঙিন পাথর, সিরামিক, বা কাচের টাইল মিশ্রিত করে তৈরি করা হয় যা পরে একটি ছবির আকার পায়। বাণিজ্যিক মোজাইক ম্যুরাল নির্মাতারা আধুনিক দিনের প্রযুক্তিতে কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার ক'রে ছবিগুকে রঙে আলাদা করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে জালের চাদরের উপর লাগিয়ে দেয় এবং ম্যুরালগুলি নিখুঁতভাবে দ্রুত এবং প্রচুর পরিমাণে তৈরি করে।

কিছু বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ম্যুরাল দিলাম ।

            সান বারতেলো ম্যুরাল

জিওত্ত-র আঁকা অ্যারেনা চ্যাপেলের ম্যুরাল " ব্যাপ্তিসম অফ ক্রাইস্ট" 

মাইকেলেঞ্জেলো-র আঁকা " বার্থ অফ অ্যাডাম "

লিওনারদ দা ভিঞ্চির "দ্য লাস্ট সাপার" 


অজন্তা গুহার কিছু ম্যুরাল চিত্র


শ্রীলঙ্কার কিছু ম্যুরাল



        চিত্র সৌজন্যঃ উইকিপিডিয়া ও আন্তরজাল 
c

0 Comments

আপনার বক্তব্য