পদক্ষেপ
লেখিকা -- শ্বেতলীনা
মলয় শেষ বারের মত চেষ্টা করল বাবা মাকে বোঝানোর।যদি রাজী করানো যায় কোনোভাবে। কিন্তু কুহেলীর নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে বাবা প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, “ না না না। কোনও ভাবেই আমি ওই ভিখারী বাড়ির মেয়েকে আমার বাড়ির বউ হতে দেব না। “
অসহায় দৃষ্টিতে মলয়
মায়ের দিকে তাকালো। যদি মা একটু বাবাকে বোঝান। কিন্তু মাও ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠলেন,”
তোমার বাবার মতের ওপর তো কথা বলা উচিত হবে না। আর সত্যিই তো উনি তো কিছু ভুল বলেন নি।
সমাজে আমাদের একটা প্রতিষ্ঠা তো আছে। “ মলয় তাও অনেক চেষ্টা করল বোঝানোর। কিন্তু বিধিবাম।
কিছুতেই রাজী হলেন না বাবা মা।
কুহেলী আর মলয় কলেজ জীবনের বন্ধু। একসাথে কলেজ, ইউনিভারসিটি,
চাকরি, সব সময় একসাথে পাশাপাশি। থাকতে থাকতে
কখন যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল তা নিজেরাও বোঝেনি। সেই অর্থে কেউ কাউকে কোনোদিনও
ভালোবাসার কথা জানায়নি। কিন্তু নিজেদের অনুভূতিগুলো একে অন্যের কাছে ব্যক্ত হয়ে গেছে
চোখের ভাষায়, হাতের ছোঁয়ায়, যত্নে, ব্যাকুলতায়। দুজনের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য
অনেকটাই। মলয় ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। নামকরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক মলয়ের বাবা।
অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্খী তিনি ও তাঁর স্ত্রী। নিজেদের এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে নিজেদের
সামাজিক প্রতিষ্ঠা আরও বাড়াতে চান। তাই মলয়ের দিদির বিয়েও দিয়েছেন নামকরা ব্যবসায়ী
পরিবারে।
সাত দিনের ছুটি নিয়ে শুধুমাত্র বাবা-মাকে রাজী করানোর জন্য
মলয় দিল্লী থেকে ছুটে এসেছিল। আজ শেষ বারের মত তাই অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু তাঁর যাবতীয়
অনুরোধ উপরোধ অরণ্যে রোদনের মত বিফল হল। মলয় এবার মরিয়া হয়ে বলল , “ আমি কুহেলীকে ছাড়া
অন্য কাউকে বিয়ে করব না।কিছুতেই না।“
মলয়ের বাবা হীমশীতল কণ্ঠে শেষ রায় ঘোষণা করলেন, “ আমি বেঁচে
থাকতে ওই মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। আমার বাড়িতে ওই বউকে আমি ঢুকতে দেবো না। এরপরেও
যদি তুমি জেদ কর তাহলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে পারো।“
মলয় আর দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ না করে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে
বুঝল তাঁর বক্তব্যও এক। মলয় উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে গিয়ে সব জিনিস গুছিয়ে বাড়ি থেকে
বেড়িয়ে গেল।
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা কুহেলীদের বাড়ি গেল। কুহেলীর বাবার
কাছে হাতজোড় করে বলল,” আমায় ক্ষমা করুন আমি পারলাম না। এবার আপনারাও যদি পাশে না থাকেন
তাহলে আমরা নিরুপায় হয়ে এই ভাবেই চলে যেতে
বাধ্য হব। যদি পাশে থাকেন তাহলে দুমাস পরে এসে আমি কুহেলীকে বিয়ে করে নিয়ে যাব।“
দু’মাস পর শুভদিনে কুহেলীর বাবা-মায়ের সম্মতিক্রমে মলয়-কুহেলী
সাতপাকের বাঁধনে বাধা পড়ল।সেই থেকে দিল্লীতে তাঁদের নতুন সংসার। মলয়ের সাথে ওর পরিবারের
কারোর কোনও যোগাযোগ নেই। এই ঘটনা কুহেলীকে খুবই কষ্ট দেয়। অপরাধবোধে আচ্ছন্ন রাখে।বেশ
কয়েকবার চেষ্টা করেও তাঁদের মন বদলাতে পারেনি। যোগাযোগ ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতম হয়ে
যায়।
বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পর মলয় হঠাৎ খবর পায় বাবার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার।লেনদারদের পাওনা মেটাতে বাড়ি বন্দক দিতে হয়েছে। ভাড়াবাড়িতে থাকছেন বাবা-মা। সেখানেও খুবই কষ্টকর অবস্থা। কুহেলীও শোনে সব কথা। সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত সময় লাগে না কুহেলীর।
আজ কুহেলী মলয়ের বাবার হাতে তুলে দেয় বন্দকমুক্ত করা বাড়ির দলীল। যে বাড়িতে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি, সেই বাড়িতে সে প্রবেশ করায় সেই মানুষদের, যাঁদের চোখে সে “ভিখারী বাড়ির মেয়ে”। আজ সেই ভিখারী বাড়ির মেয়ের হাত থেকে বাড়ির দলীল হাত পেতে নিতে মলয়ের বাবার অসুবিধা হয়না। হয়তো আজ সামাজিক অবস্থান যে মানুষের পরিচয় বহন করেনা সেই শিক্ষা নতুন করে লাভ করেন। দলীল হাতে দিয়ে কুহেলী দৃপ্ত কিন্তু শান্ত পদক্ষেপে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। মন আজ অপরাধ বোধ ও অপমানের থেকে ভারমুক্ত।"জীবনে কিছু পদক্ষেপ এমন নেওয়া উচিত যা মাথা উঁচু করে দেয়, আবার জীবনে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয় যা মাথা নিচু করে দেয়। তাই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে এবং ভেবে চিন্তে নেওয়া উচিত", কুহেলী মনে মনে বলে।
চিত্র সৌজন্যঃ https://in.pinterest.com/pin/261419953342322187/
0 Comments
আপনার বক্তব্য