ADHD বা শিশুদের মনোযোগ ঘাটতি ব্যাধি

শিশুদের ADHD বা শিশুদের মনোযোগ ঘাটতি ব্যাধি 



 চঞ্চলতা যে কোনও শিশুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। শিশুরা যখন-তখন হাসবে, খেলবে, দুষ্টুমি করবে, হইচই করবে, সমবয়সী ও সহোদরদের সঙ্গে ঝগড়া করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ভাবনার বিষয় হলো যদি শিশুর এই চঞ্চলতা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং তার কারণে শিশুর দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।কিছু শিশুর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চঞ্চলতা এক এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তারা কোনো কাজই ঠিক ভাবে করতে পারেনা। লেখা বা আঁকা বা পড়া বা খেলা যে কোনো বিষয়েই অস্থিরতা চরম মাত্রায় পৌঁছায় , ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। অতিরিক্ত চঞ্চলতার ফলে বারবার দুর্ঘটনার শিকার হতে থাকে। বিশেষত এই ধরণের শিশুরা এক স্থানে বেশিক্ষণ বসতে বা দাঁড়াতে পারেনা।এই শিশুরা শুধু শারীরিকভাবেই চঞ্চল নয়, তাদের মস্তিস্কও একইরকম কর্মব্যস্ত থাকে। তাদের চিন্তাধারার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকে স্থির থাকে না- এই এখন এদিকে মন, পরক্ষণেই অন্য কিছু নিয়ে ভাবনা।তার প্রতিফলন তাদের প্রতিটি কাজে লক্ষ্য করা যায়। ইদানিংকালে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুরভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই রোগকে বিশেষজ্ঞরা ADHD - Attention Deficit Hyperactivity Disorder বা মনোযোগ ঘাটতির ব্যাধি বলে চিহ্নিত করেছেন।

ADHD সাধারণ মানসিক ব্যাধিগুলোর একটি। এটি মস্তিষ্কের মনোযোগ-সংক্রান্ত এক অসুস্থতা। Attention Deficit মানে মনোযোগের অভাব, আর hyperactivity মানে অতি চাঞ্চল্য। এডিএইচডি মূলত শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়, তবে শিশুদের ছাড়াও অনেক প্রাপ্তবয়স্কের এই ব্যাধি প্রভাবিত করে।

লক্ষণসমুহঃ

ADHD-মূল তিনটি উপসর্গ হলো

  • ইন-অ্যাটেনটিভঃ মনযোগ রাখতে সক্ষম নয় এমন।ভুলে যাওয়া বা জিনিস হারিয়ে ফেলার প্রবণতা, একটি কাজ সম্পূর্ণ করতে অসুবিধা, নির্দেশ অনুসরণ করতে অসুবিধা,একাধিক নির্দেশ মেনে চলে কাজ সম্পূর্ণ না করতে পারা, সহজে মনসংযোগে ঘাটতি হওয়া, দৈনিক কাজ মনে রাখতে অসুবিধা।
  • হাইপারঅ্যাকটিভিটিঃ প্রয়োজনের তুলনায় অতি-সক্রিয়। একটানা স্থির ভাবে বসে থাকতে বা কোনো কাজ করতে অসুবিধা, দুর্ঘটনা প্রবণ, দ্রুত অস্থির আচরণ, একটানা কথা বলে যাওয়া, অন্যের মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা, অন্যকে সুযোগ না দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার প্রবণতা।
  • ইম্পালসিভিটিঃ চিন্তা ছাড়াই দ্রুত ঘটে এমন কাজ করা। ধৈর্যের অভাব। অন্যকে অকারণে বিরক্ত করা। হঠাৎ হঠাৎ করে যে কোনও কাজ করে ফেলা।

কারণসমুহঃ

অতীতে ADHD-র সঙ্গে জিনগত সম্পর্কের কথা বলা হলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ‘মলিকিউলার সাইকিয়াট্রি’ বিভাগের অধ্যাপক রয় পেরলিসের গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় মানসিক রোগের ওষুধ সেবন বাচ্চার ADHD হওয়ার পেছনে বহুলাংশে দায়ী। ADHD -র কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় এখনো সম্ভব হয়নি। তবে আপাতদৃষ্টিতে গবেষকেরা কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন।

  • শরীরে জিংকের ঘাটতি ও শিশু খাদ্যের সঙ্গে মেশানো কৃত্রিম রং ADHD জন্ম দিতে পারে।
  • অপুষ্টিজনিত কারণে এবং বংশগত কারণে শিশুর মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
  • আবার গর্ভাবস্থায় ধূমপান, কোনো প্রকার মাদক সেবন বা অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবন থেকেও শিশুর মধ্যে ADHD দেখা দিতে পারে।
  • নির্ধারিত সময়ের আগে জন্মানো অপরিণত ও কম ওজন বিশিষ্ট শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় কোনও দুর্ঘটনার ফলে মস্তিস্কে আঘাত লাগলে এই রোগ হতে পারে।

প্রতিকারসমূহঃ

  • মনে রাখতে হবে যেADHD-তে আক্রান্ত শিশুদের জন্য নিজের আবেগ ও আচরণ দমন করা বেশ কঠিন। অর্থাৎ, কোনো কাজ করার আগে তারা পরিস্থিতি বা কাজের ফলাফল বিবেচনা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ADHD আক্রান্ত শিশুকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করতে হলে, পারিবারিক সহযোগিতা একান্ত জরুরি।
  • কোনো শিশুর মধ্যে এমন আচরণগত সমস্যা যদি ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
  • বয়স অনুযায়ী শিশুর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুর যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।সাধারণত বলা হয় শিশুর পেট যেন সবসময় ভর্তি থাকে। কারণ এদের ক্ষিদের বোধ থাকেনা। কিন্তু খিদে পেলে অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
  • দিনের পরিকল্পনা করা বিশেষ জরুরি; যেন শিশু বুঝতে পারে তার কাছে কী আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কী ধরনের আচরণ আশা করা হচ্ছে তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ইতিবাচক আচরণকে তাৎক্ষণিক পুরস্কার বা প্রশংসার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে হবে।
  • বিভ্রান্ত না করে সুস্পষ্টভাবে শিশুকে নির্দেশনা দিতে হবে।একসাথে অনেক কাজ নির্দেশ না করে ছোট ছোট করে নির্দেশ করতে হবে। মনে রাখার বিষয় হল এই বিশেষ শিশুরা একসাথে একাধিক নির্দেশ ( Multiple Instructions) পালন করতে অপারগ হয়। তাই একবারে একটি নির্দেশ দেওয়াই উচিত। এবং কাজ সম্পূর্ণ করতে সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে।
  • শিশুকে পরিবারের বাইরেও মেলামেশার সুযোগ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশু আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলে। সে ক্ষেত্রে শিশুর খেলা বা মেশার সময়কে সংক্ষিপ্ত রাখতে হবে।
  • পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য শিশুকে শারীরিক ব্যায়ামে অভ্যস্ত করতে হবে।হালকা প্রাণায়াম বা ধ্যান খুব উপকারী হয় এক্ষেত্রে। তাছাড়া এমন কিছু খেলা যেমন ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার, স্কোয়াশ প্রভৃতি খেলতে দিতে হবে যার ফলে প্রচুর পরিমানে শক্তিক্ষয় হয়। ক্লান্তি এলে আস্তে আস্তে শিশু শান্ত হবে ও মনঃসংযোগ বাড়বে।
  • বাড়ির পরিবেশ শান্ত হতে হবে। বারবার বাসস্থান বা বিদ্যালয় বদল এদের ক্ষেত্রে খুব ক্ষতিকর হয়। তাই একই পরিবেশে থাকতে দিতে হবে।
  • গান, বাজনা বা আঁকার দিকে উৎসাহ দিতে হবে। এতে ধীরে ধীরে মনঃসংযোগ বৃদ্ধি পাবে। এনার্জি চ্যানেলাইজ করা দরকার ।
  • নিজেদের ব্যবহার শান্ত রাখুন। শিশুর চঞ্চলতায় বিরক্ত প্রকাশ বা শাসন করা উচিত হবে না।
  • যে ADHD শিশুটি বসতেই চায়না এবং চাঞ্চল্য কখনোই থামেনা, তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে তার Energy Release এর পদ্ধতি বের করুন, যাতে সে স্বীয় চাঞ্চল্যসহ বসে থেকে অন্য কাউকে বিরক্ত না করে। এ ক্ষেত্রে তাকে তার হাতে স্ট্রেস বল বা অন্য কোনো কিছু ধরিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে রাখতে পারেন, যাতে সে সেটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চিউয়িং গামও এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ভালো কাজে দেয় । এক্ষেত্রে ক্লে মডেলিং খুব কাজে দেয়। ডাক্তাররাও ক্লে মডেলিং এর সাহায্য নিতে উপদেশ দেন।
  • পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। অন্তত দিনে ৮-১০ ঘণ্টা নিরুপদ্রব ঘুম দরকার শিশুর। মস্তিস্ক যত বিশ্রাম পাবে তত উপকার হবে।
  • শিশুর মতামতকে গুরুত্ব দিন। তার যে কোনো কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। অনুভব করাতে হবে যে সেও পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

  • ADHD নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে আমাদের মনে। অনেকেই ভাবেন ADHDর সঙ্গে অন্য কোনো মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সম্পর্ক নেই। কিন্তু সত্যটা হলো, এডিএইচডিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয়, তবে পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যাগুলো হলো —
    • কনডাক্ট ডিসঅর্ডার (আচরণগত সমস্যা), মুড ডিসঅর্ডার (মেজাজ-মর্জিগত সমস্যা), অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার(মানসিক উদ্বিগ্নতা) এবং লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি (শেখার অক্ষমতা)।
    • হাইপার অ্যাকটিভ বাচ্চা মানেই সে ADHDতে আক্রান্ত, এমন ধারণা সঠিক নয়। বাচ্চারা চঞ্চল হবেই। তবে সেটা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তবে ADHD নিশ্চিত করতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। ADHD দূর করতে ওষুধই একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন অনেকে। এটা ভুল। সাধারণত ADHDর ওষুধগুলোর প্রভাব ছয় ঘণ্টা থেকে আট ঘণ্টা স্থায়ী হয়। কাজেই ওষুধের পাশাপাশি সমস্যার কার্যকরী চিকিৎসা হিসেবে আচরণগত ও জীবনযাত্রাগত নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে।
    • আপনার শিশু আপনার ভবিষ্যৎ। তাকে সময় দিন, পাশে থাকুন, তার আচরণ সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করুন। যদি তার আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেন, ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
    • ছোট ছোট কাজের জন্য ভুয়সী প্রশংসা করুন, পুরষ্কার দিন, উৎসাহী করুন। এতে কাজ করার ইচ্ছা তৈরি হবে।
    • তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে সহায়ক হিসেবে আপনি প্রধান ভূমিকা পালন করুন। ডাক্তার ও স্কুল মাস্টারদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আপনার শিশুকে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বা চেষ্টা করতে সাহায্য করুন
    • প্রায় সব শিশুর মধ্যেই কমবেশি ADHDর প্রভাব রয়েছে। শিশু মানেই দুরন্তপনা; শিশু মানেই চঞ্চল, উৎফুল্ল। এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে আপনার শিশুটি যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়।

  • ADHD শিশুদের হাইপার‍্যাক্টিভিটি যদিও কিছু পরিস্থিতিতে অসংযত আচরণ বলে স্বীকৃত, কিন্তু একটি কথা মনে রাখবেন এই অতিচঞ্চলতার কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। এসব শিশুদের ক্রমাগত চঞ্চলতার পাশাপাশি তাদের Endless Energy একটি বিস্ময়ের ব্যাপার। আপনার ADHD শিশুর চঞ্চলতাকে পরিহার করিয়ে তার Endless Energy কে কিভাবে তার জীবনে ইতিবাচক সাফল্যের সোপান বানাবেন সে ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে পারেন।এই ধরণের শিশুরা খুব ভালো খেলোয়াড় হন। সেদিকে চেষ্টা করলে জীবনে অবশ্যই উন্নতি করবে।

সকলের সহায়তায় বিনা ওষুধে শিশু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রয়োজন অফুরন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতা। যদি নিজের সন্তানের মধ্যে এই ধরণের কোনো অস্বাভাবিক আচরন পরিলক্ষিত করেন তাহলে অবশ্যই একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। কারণ চঞ্চলতা বা হাইপারঅ্যাকটিভ হওয়া মানেই ADHD রোগে আক্রান্ত নয়।


ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।🍀 

__________________________________________________________________________________


তথ্যসুত্রঃ https://kidshealth.org 

https://www.psychiatry.org

https://www.healthline.com

চিত্রসুত্রঃ গুগল 

0 Comments

আপনার বক্তব্য