শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধির উপায়

 

শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধির উপায়


গত কয়েক দশকের শিশুদের ব্যবহারে নজর দিলে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় যে, বেশিরভাগ শিশুই অত্যন্ত দুরন্ত ও চঞ্চল প্রকৃতির। তা সে যে বয়েসেরই হোক না কেন। অধিকাংশ বাবা-মায়েরই নিজের সন্তান সম্পর্কিত অভিযোগগুলো প্রায় এক। সমস্ত অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পড়াশোনায় অমনোযোগিতা। কারো সন্তান পড়তে চায় না, কারো সন্তান লিখতে চায় না, কেউ বারবার পড়া ছেড়ে খেলতে শুরু করে, কেউ পড়তে বসলে ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ পড়তে বসলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, কেউ আঁকতে দিলে রং করতে চায় না  ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন বয়েসের শিশুর জন্যই থাকে বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ। খুদেদের নানাবিধ অমনোযোগিতার বর্ণনা শুনতে বেশ মজা লাগে।তবে, অমনোযোগিতারও কম-বেশি থাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে  বাচ্চার বয়সের উপরে তার মনোযোগ নির্ভর করে। ৪-৫ বছরের বাচ্চা ও ৮-১০ বছরের বাচ্চার মনোযোগ এক হ না। মনোযোগ বাড়াতে হবে ধীরে ধীরে অভ্যেসের মাধ্যমে। শিশুকে প্রথম দিনেই টানা দু’ঘণ্টা পড়তে বসালে সে বসবে না। সে ক্ষেত্রে প্রথম এক সপ্তাহে আধ ঘণ্টা পড়তে বসাতে হবে। ধীরে ধীরে সেই সময়সীমা বাড়াতে হবে। সন্তানের মনোযোগ কম না বেশি, তা মা-বাবা সব সময়ে বুঝতে পারেন না। সেটা তার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন।তাই এক্ষেত্রে শিক্ষক- শিক্ষিকাদের সাথে আলোচনা করে নেওয়া ভালো।  তবে ছোট থেকে কিছু অভ্যেস তৈরি করে দিলে অমনোযোগিতাকে অনেকটাই আয়ত্তে আনা যায়।



প্রথমে শিশুর অমনোযোগী হওয়ার কারণ গুলো জানা প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে একটি শিশু অমনোযোগী হতে পারে। যেমন –


  •         অপছন্দের বিষয়।
  •          একটানা স্থির হয়ে বসে থাকার অক্ষমতা।
  •          কোনো বিষয়ে স্থিরভাবে চিন্তা করার অক্ষমতা।
  •          সহজেই অন্যমনস্ক হয়ে পরার প্রবণতা।
  •          দিবা স্বপ্ন দেখার অভ্যাস।
  •          নির্দেশ মানার অক্ষমতা।
  •          কোনো কিছু সুসংহত করে রাখার অক্ষমতা।
  •          শারীরিক কোনো অসুস্থতা ।
  •      কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে হাইপার অ্যাকটিভিটি বা ADHD বা অন্য কোনো জটিল মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা। এই বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্যই শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে শিশু মনোবিজ্ঞানীর সাহায্যও নিতে হবে।

 

 শিশুকে মনোযোগী  করে তুলতে গেলে কিছু পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধীরে ধীরে যাতে শিশু   মনোযোগী হয়।  


 

  •      গল্প বলাঃ প্রতিদিন নিয়ম করে দিনের কোনো এক সময়ে শিশুকে গল্প বলতে হবে। বই পড়ে হোক বা মুখে গল্প বলেই হোক। এর ফলে শিশুর শোনার অভ্যাস তৈরি হবে। ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে শিশুর নিজের বই পড়ার আগ্রহও বৃদ্ধি পায়।শুরুতে বাবা- মাকে বই পড়ে দিতে হবে। ধীরে ধীরে বাচ্চাকে বই পড়ার দিকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সাধারণত শিশুরা বাড়ির বড়দের নকল করতে থাকে। তাই যদি বাবা- মা বই পড়ার বিষয়ে আগ্রহী হন তাহলে তাঁদের দেখে শিশুও বই পড়া শিখে যাবে। 



v      বিভিন্ন ধরণের খেলার মাধ্যমেঃ

 

o   খেলনাঃ এখন প্রচুর ইন্ডোর গেমস, বই পাওয়া যায়, যা বাচ্চার কগনিটিভ স্কিল বাড়ায়- যেমন নানা ধরনের অ্যাকটিভিটি বুক, বিল্ডিং ব্লকস, পাজলস, সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড ইত্যাদি।এর থেকে মনোযোগের সাথে সাথে চিন্তাশক্তিও বৃদ্ধি পায়।

o   ছবি থেকে ভুল খুঁজে বার করা বা একই ধরণের ছবিতে অমিল খুঁজে বের করার মত খেলা গুলোও এক্ষেত্রে উপযোগী ভুমিকা নেয়।

o   ক্রম অনুযায়ী সাজানো- যথা ঘরের ছোট ছোট জিনিস সাজিয়ে রাখা, অক্ষর অনুযায়ী বানান লেখা বা ক্রম পর্যায়ে অক্ষর বা নম্বর সাজানো প্রভৃতি খেলাও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

o   “স্ট্যাচু” হয়ে খেলা। এই মজার খেলার ফলে বাচ্চাকে একই স্থানে বেশ খানিকটা সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হয়।প্রায়ই এই খেলা খেলার ফলে মানসিক স্থিরতা বাড়ে।

o   খেলার মাধ্যমে জিভ জড়ানো বাক্য ( tongue twisters)  বলতে শেখানো।

o    শূন্যস্থান পূরণ করার খেলা। বিভিন্ন নম্বর বা অক্ষর বা শব্দের সাহায্যে খুব সহজেই শিশুকে এই খেলা খেলানো যায়। মজার এই খেলা শিশুকে যে শুধু পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলে তাই নয় অনেক নতুন জিনিস অতি সহজেই শিখিয়েও দেয়।  

o   এছাড়া কম্পিউটারে বিভিন্ন বয়েসের শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন ধরণের শিক্ষামূলক খেলা পাওয়া যায়। যেমন কুইজ করা, রং করা, পাজল খুঁজে বার করা, ছোট গল্প পড়ে তার উত্তর দেওয়া, অঙ্ক করা প্রভৃতি যেগুলোর মাধ্যমেও শিশুর মনোযোগ বৃদ্ধি হয়।

o   ৫/৬ বছরের পর দাবা খেলা শেখাতে পারলে খুব মনোযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুবই উপকারী হয়।

o   মেমরি গেম একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খেলা । এর সাহায্যেও শিশুর মনোযোগ বাড়ে।

খেলাধুলাঃ যে কোনো বয়সের শিশুর জন্যই খেলাধুলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রতিদিন বিকালে বা সকালের কোনো এক সময় এক থেকে দু’ঘণ্টা খোলা মাঠে খেলতে দেওয়া দরকার। বর্তমানে খোলা মাঠ পাওয়া এক বড় সমস্যা ঠিকই কিন্তু সেক্ষেত্রে এমন কিছু খেলার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শারীরিক পরিশ্রম হয়।টেবিল টেনিস বা ব্যাডমিন্টন ও সেক্ষেত্রে উপযোগী হয়। 


  • গান-বাজনাঃ ছোট থেকে গান বা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর তালিম মনোযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী প্রমাণিত হয়েছে। বলা হয় সুর শেখার থেকে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শেখার জন্য দরকার যথেষ্ট পরিমাণ মনোযোগ। শিশুকে বাদ্যযন্ত্র পছন্দ করতে দিতে হবে। যেটা তার পছন্দ সেটাই শেখানো উচিত। তাহলে আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।  
  • উপযুক্ত পরিবেশঃ শিশুকে পড়াশোনার জন্য শান্ত নিরিবিলি ঝঞ্ঝাটহীন পরিবেশ দিতে হবে। পড়ার ঘরে টিভি, ফোন বা অন্য কোনো ধরণের মনোযোগ নষ্টকারী বস্তু জেন না থাকে তাঁর দিকে নজর দিতে হবে। বাড়ির পরিবেশ অবশ্যই যেন শান্তি পূর্ণ হয়।পড়ার সময়  বাবা বা  মাকে এক জায়গায় বসে শিশুর পড়ার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাবা- মা শান্ত স্থির হয়ে বসলে সন্তানও তাই করার চেষ্টা করবে। পড়ার জায়গায় পড়ার প্রয়োজনীয় উপাদান সামগ্রী যেন মজুদ থাকে। বই, খাতা, পেন, পেন্সিল, রং, খাবার জল প্রভৃতি জিনিস যেন পড়ার জায়গার কাছেই থাকে। যাতে এই সব জিনিসের প্রয়োজনে বাচ্চাকে বারবার অন্য জায়গায় যাওয়ার প্রয়োজন না পড়ে।
  • নিয়মিতকরনঃ  প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে পড়তে বসার অভ্যাস করা খুবই জরুরী। প্রতিদিনের সময়কে নির্দিষ্ট কাজের জন্য ভাগ করে দিতে হবে। স্কুল থেকে ফেরার পর খাওয়া,অল্প ঘুম, খেলা এবং পড়া – এইভাবে চক্রাকারে প্রতিদিন নিয়মিত করলে বাচ্চা স্বাভাবিকভাবেই এগুলো শিখে যাবে।

v         স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও  পর্যাপ্ত ঘুমঃ

o   প্রতিটি শিশুর প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর খাবার। ফল, সব্জী, প্রোটিন,কার্বোহাইড্রেট ও  ভিটামিন – মিনারেলের সঠিক পরিমানে খাবার সঠিক পরিমানে শিশুর আহারে থাকা খুব দরকার। এতে সঠিক মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে।

o   প্রতিটি শিশুর প্রতিদিন ৮- ১০ ঘণ্টার পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। স্কুল থেকে ফেরার পর অনেক বাচ্চার ঘুমের অভ্যাস থাকে না। এটি ক্ষতিকর। স্কুল থেকে ফিরে অল্প ঘুম শিশুর কর্মক্ষমতা ও শক্তির যোগান বৃদ্ধি করে। ফলে পড়ার সময় ক্লান্তিতে অমনোযোগী হওয়ার অবকাশ থাকে না।

  •       ছোট কাজে ভাগঃ যে কোনো কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ কর দিতে হবে। একটি ভাগ শেষ হলে একটু বিশ্রাম দিতে হবে। বা ছোট্ট একটু খেলতে দিতে হবে। কাজ শেষ হলে উৎসাহ এবং প্রশংসা দুইই করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর ফলে শিশু পরবর্তী কাজ করার উৎসাহ লাভ করবে। নিজের আগ্রহে পরবর্তী অংশের কাজ সম্পন্ন করবে।
  •       পড়ার পদ্ধতিঃ শিশুর চাহিদা অনুযায়ী পড়ার পদ্ধতি নির্ধারণ করা জরুরী। কিছু বাচ্চা শুনে শুনে পড়তে ভালো বাসে, কিছু বাচ্চা নিজেরা বই পড়তে পছন্দ করে,কিছু বাচ্চা বিভিন্ন অ্যাকটিভিটির মাধ্যমে পড়তে ভালোবাসে, কেউ জোরে জোরে পড়ে, কেউ আস্তে আস্তে নিঃশব্দে পড়ে। প্রত্যেকের পদ্ধতি পৃথক। বাচ্চার পছন্দ অনুযায়ী তাকে পড়তে দেওয়াই উচিত। জোর করে কোনো কিছু করতে বাধ্য করলে শিশু পড়াশোনা বিমুখ হয়ে যায়।
  •       সময়ানুবর্তীতাঃ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ছোট ছোট লক্ষ্য দিতে হবে, যাতে সহজে বাচ্চা তা সম্পূর্ণ করতে পারে। লক্ষ্যপুরনে অবশ্যই প্রসংশা করতে হবে। অনেক সময় বাবা- মায়েরা লোভ দেখিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করেন। যা পরবর্তীকালে অন্য আকার ধারণ করে। তাই জিনিসের লোভ দেখিয়ে পড়াশোনা করানোর চেষ্টা থেকে দুরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।

  •      প্রানায়ামঃ প্রানায়াম বা ব্যায়াম ছোট বাচ্চাদের পক্ষে যদিও কঠিন কাজ, তবু চেষ্টা করলে ফল ভালো হয়। এক্ষেত্রে বাবা- মা দুজনকেই এক সঙ্গে প্রানায়াম বা ব্যায়াম করতে হবে। তবেই শিশু করার আগ্রহ পাবে। প্রানায়ামের মাধ্যমে মানসিক স্থিরতার মাধ্যমে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।

 

উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ বৃদ্ধি পেতে  সাহায্য করে। কিন্তু কোনো কিছুই একদিনে বা তাড়াতাড়ি হওয়ার মত ব্যপার নয়। দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টার ফলে ধীরে ধীরে মনোযোগ তৈরি হয়। তাই বাবা- মাকে ধৈর্যশীল হতে হবে, তবেই আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব।      

ভালো থাকুন। সুস্থ রাখুন। 🍀

চিত্র সৌজন্যঃ www.vectorstock.com, গুগল 

0 Comments

আপনার বক্তব্য