নষ্ট বন্ধুত্ব

 

নষ্ট বন্ধুত্ব

লেখিকা -  শ্বেতলীনা 

 


“ আমি পাক্কা এগারো বছরের বড় তোর থেকে। সন্মান দিয়ে কথা বল দীপ্ত।“ দীপ্তর বলা প্রাপ্তবয়স্ক কৌতুকে হাসতে হাসতে চোখ পাকিয়ে বলল তৃষা।

“মোটেই না। তুই আমার থেকে ঠিক দশ বছর সাত মাসের বড়।“ মনোযোগ দিয়ে লুচি আর কীমার তরকারিতে কামড় দিয়ে বলে দীপ্ত।

“ ওহ ! আচ্ছা। মানে পাঁচ মাস বেশি বলে ফেললাম আর কি!! আমি এখন পুরো পঁয়ত্রিশ। আর তুই মোটে চব্বিশ। কিডো।  “ – বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তৃষা।জানে “কিডো” বললেই দীপ্ত তেলেবেগুনে চটে ওঠে। আর ওর সুন্দর মুখটা আরও মিষ্টি লাগে তখন।

“ বাজে বকিস না। আমি চব্বিশ আর তুই ওই হলি গিয়ে সাতাশ। কে তোকে দেখে বলবে রে তুই পঁয়ত্রিশ? জবরদস্তির এই বুড়ি সাজার ন্যাকামোটা বন্ধ কর। আর কিডো বলতে বারণ করেছি না। কে কিডো? আমি রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্ক। ” – রেগে লাল হয়ে গিয়ে জবাব দীপ্তর। দীপ্তর মতে তৃষাকে দেখলে তেইশ – চব্বিশই লাগে। কথাটা খুব যে মিথ্যা বলে না দীপ্ত, সেটা ছিপছিপে ছোটখাটো চেহারার তৃষা জানে।কিন্তু তাও প্রশয় দিতে পারে না বিশেষ।

তৃষা আরও হেসে বলে, “আর মিথ্যা বলে পাপ বাড়াস না। ভাগ্যিস বলিস নি ষোল বছর লাগে। তোর বেশ সুবিধা হত তাহলে।“  

দীপ্ত আর তৃষার রোজকার হাসির বিষয় হল ওদের বয়েস নিয়ে এই খেলাটা। তৃষা যত মজা পায় এতে , দীপ্ত তত ক্ষেপে লাল হয়।রোজ অফিসে দুপুরের খাওয়ার সময় আর বিকালে চা বিরতির সময়টুকু এইভাবেই দুজনে উপভোগ করে নেয়।

বছর খানেকের পরিচয় কখন যে আপনি থেকে তুই হয়ে  ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়ে গেছিল টের পায়নি কেউই। হঠাৎ করেই অফিসের ট্রেনিং নিতে গিয়ে আলাপ। সেই আলাপ আজ প্রলাপে পরিণত। সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবধি  দীপ্ত কি কি করে না করে সব তৃষাকে না বলা অবধি যেন ওর পেটের ভাত হজম হয় না। প্রতিদিন মন দিয়ে তৃষাকে শুনতেই হবে। তৃষাও শোনে গভীর মনোযোগ দিয়ে সব কথা। যেন হঠাৎ পড়া ধরে ফেললে যদি না বলতে পারে হয়ত কানমলা খেতে হবে সেই ভয়। আসলে তৃষাও সারাদিনে এই সময়টুকুর অপেক্ষা করে থাকে। এই ছেলেমানুষিটা মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করে। সারাদিনের একাকীত্ব এই একটু সময়ের জন্য ভুলে যায়।এই একটা মানুষ যার সাথে কথা বলার সময় একটু হাসতে পারে, এই একটাই মানুষ আছে এই মুহূর্তে ওর জীবনে যে ওর কোনো দোষ দেখতে পায় না কোনো ব্যপারেই। সবেতেই ঠেলে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভাঙ্গা গলার গান শুনেও যে বলে আহা কতদিন পর এত সুন্দর মিষ্টি গলা শুনলাম। জানে তৃষা, বোঝেও সব। ওর মন ভালো করার চেষ্টা এগুলো।

এক একদিন তৃষা এই ধরণের মিথ্যা স্তুতি শুনে মুচকি হেসে বলে, “ আর ত্যালাস না। লাভ বিশেষ হবে না। বরং এই গুলোর জন্য নতুন তোর বয়সী কাউকে খুঁজে নে। “

দীপ্তও সমান তেজে বলে ওঠে, “কেন তোর কোন অসুবিধা হচ্ছে শুনি? আমি মিথ্যা বলছি? যা গিয়ে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখ মিথ্যা কিনা? শুনতে কি খারাপ লাগলো? আর লাভ তো হচ্ছে আমার। তুই বুঝবি না। এই যে কীমা লুচি, আলুর পরোটা, পোলাও বানিয়ে বানিয়ে খাওয়াস, সেগুলোর লোভ কম নাকি রে? নাহলে ওই ক্যান্টিনের রুটি আর ঘ্যাঁট খেয়ে জীভ পচে যেত এতদিনে। ”

তৃষা অবশ্য অস্বীকার করতে পারেনা যে মাঝে মাঝে এইসব শুনতে ভালোই লাগে তার। স্তুতি শুনতে কার না ভালো লাগে। হোক না তা মিথ্যা। তবু কেউ তো বলে।  

 দীপ্ত অবশ্য  নিজের মন উজাড় করে কোনো রাখঢাক না রেখেই তৃষাকে এর মধ্যেই একদিন বলে দিয়েছে,  তৃষ্ণাকে অসম্ভব ভালোবাসে ও। ওর ভাষায় “ শোন তোকে চাপ নিতে হবে না। আমি তোকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। তার মানে এই নয় যে তোকেও জোর করে বাসতে হবে। এখুনি না বাসলেও চলবে।তুই ধীরে ধীরে ভালোবাসিস। “

শুনে তৃষা উচ্চকণ্ঠে হেসে ফেলেছিল – “ মানে তোকে ভালোবাসতেই হবে আমাকে? তারপর আমিও যদি সহেলি হয়ে যাই তখন? রোজ অশান্তি করি এটা সেটা ওটা নিয়ে ?যতই হোক প্রমিকের কাছে আজকালকার মেয়েরা তো শুধু টাকা-পয়সা-জিনিসপত্র এইসবই চায়।আমিই বা ব্যতিক্রম হব কেন? কি করবি? আবার ব্রেক -আপ? ”

দীপ্তর চটজলদি জবাব – “ কেন আমি কি খারাপ নাকি? দেখতে বাজে? ভালবাসবি না কেন? আর সহেলির ব্যপারটা তুলিস না। তুই কি আজকালকার মেয়ে নাকি? যে ওই রকম করবি?  “

“ ও ও মানে অমনি আমি বুড়ি হয়ে গেলাম? তোর সুবিধামত একবার চব্বিশ আর একবার পঁয়ত্রিশ নাকি ? ব্যাটা ধান্দাবাজ।” বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে তৃষা।  

দীপ্তও এবার হাসতে থাকে। বলে, “তোর মাইরি উকিল হওয়া উচিত ছিল। কি কথা কোথায় নিয়ে গেলি?মাঝখান থেকে আমার প্রেমের ঘণ্টা বেজে গেল। চল আবার কাজে লাগি। তবে আজ একটা কথা দিলাম তোকে আর যাই হোক না হোক, আমাদের বন্ধুত্বটা কিন্তু থাকবে, চিরকাল। এইটুকু কথা অন্তত দে আমায়। ছেড়ে যাবি না আমাকে কোনদিনও।এইভাবেই পাশে থাকবি সারাজীবন। “

দীপ্তর বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরল তৃষা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। মুখে বলল,” আমি কাউকে ছেড়ে যাই না রে, সবাই আমায় ছেড়ে যায়।“ মনে মনে বলল তুই অন্তত ব্যতিক্রম হয়ে দেখাস।আর কাউকে হারানোর ব্যাথা সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। থেকে যাস।

দীপ্ত , তৃষার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, “ কোনোদিনও যাবো না তোকে ছেড়ে। সারাজীবন তোর ঘাড়ে চেপে থাকব দেখিস। কথা দিলাম। শেষদিন অবধি তোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবো। তোকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না আমার। “ দুজনেই অনাবিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে।  

তৃষার পরিণত মন বোঝে দীপ্তর মনকে। খুব ভালো করেই অনুভব করে ওর ভালোবাসাকে।দুজনের এতোটা কাছে আসার কারণটাও অনেকটা এক। এক অদ্ভুত দুঃসময়ে দুজনের দেখা।যে সময় দুজনেই বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিল। একাকীত্ব, অবসাদ ঘিরে ধরছিল দুজনকেই। হয়ত তাই দুজনেই মানসিকভাবে এত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে একে অন্যের উপর। তৃষা অনুভব করে নিজের মনের গোপনে চোরাবালির স্রোত।টের পায় নিজের দুর্বলতা। কিন্তু ফলাফল টাও জানে ভালো করে।  তাই আরও বেশি করে শিকল দিয়ে আষ্টেপিষ্টে সেই স্রোতকে বেঁধে রেখেছে নিজের ভিতরে। জানে একবার শিকল ভেঙ্গে গেলে স্রোতের ধাক্কায় ভেসে যাবে অনেক জীবন, সেই স্রোত সামলানোর ক্ষমতা দীপ্তর নেই। তৃষা দীপ্তকে হারাতে চায়না। বন্ধুত্বই যথেষ্ট তার জন্য। সারাদিনের আধা ঘণ্টাই অনেক মুল্যবান তার কাছে। বেশি চাইতে গিয়ে সেই আধা ঘণ্টা সে নষ্ট হতে দিতে পারেনা।

সেদিন দুপুরে তৃষা, দীপ্তর প্রিয় বিরিয়ানি নিয়ে গেছিল অফিসে।প্রায়দিনই তৃষা দুজনের খাবার নিয়ে যায়। দীপ্ত খেতে খুব ভালোবাসে। তৃষা ভালো কিছু রান্না করলেই ওর জন্য নিয়ে যায়। দীপ্তকে খেতে  দেখতে তৃষার খুব ভালো লাগে।

খেতে খেতে হঠাৎ দীপ্ত জিজ্ঞাসা করলো, “তুই আমাকে ভালবাসিস না । তাই না? শুধু মায়া পড়ে গেছে বোধহয় আমার ওপর। “ 

তৃষার বুকে চোরাস্রোত বয়ে গেল।হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।এই কথাগুলো শুনলে আজকাল এরকমই হয়।  তবুও হেসে বলল, “ কে বলল?”

সাথে সাথে দীপ্ত ক্ষেপে উঠলো, “ তুই সোজাভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিস না কেন বলতো? প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করিস কেন? ভীষণ বাজে স্বভাব এটা।বল না ভালবাসিস আমায়?আজ অন্তত একবার হ্যাঁ বল।  ”

“ বাসিনা বলেছি কখনও?” আবার প্রশ্নেই উত্তর দিল তৃষা

“ ফের প্রশ্ন ? সোজা হ্যাঁ বা না তে উত্তর দেওয়া যায় না?”

“ যদি বলি বাসি। কি করবি? বিয়ে করবি আমায়?”

এবার থতমত খেয়ে যায় দীপ্ত। খাওয়া থামিয়ে বড় বড় সুন্দর টানা ভ্রূ সমেত চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করে, “ তুই সিরিয়াস? সত্যি জানতে চাইছিস?”

এবার তৃষা একটু গম্ভীর হয়। কি যেন একটা ভাবে। রোজকার মত মজা করে উড়িয়ে দেয় না আজ প্রশ্নটাকে। জিজ্ঞাসা করে, “ কেন?  যদি ভালবাসিস তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধা কোথায়?সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? পারবি তোর যৌথ পরিবারকে বোঝাতে যে তুই তোর থেকে এগারো বছরের বড় ডিভোর্সি একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাস? পারবি বঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে এতো বড় বিদ্রোহটা করতে? পারবি সামাজিক ভাবে পরিচিত মহলে আমার বয়স আর অতীত পরিচয়টা দিতে? ভেবে উত্তর দিস। তাড়া নেই। এখন খেয়ে নে। ”

একটানা এতগুলো কথা বলে একটু হাঁপিয়ে যায় তৃষা। ঘরপোড়া গরু তৃষা। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের অত্যাচারের দাগগুলো এখনও শরীরের আনাচে কানাচে খুঁজলে পাওয়া যাবে। তাই দু’বছরের নিদারুণ ক্লান্তিকর আইনি যুদ্ধের অবসানে, যেদিন কোর্ট তাকে সেই অভিশপ্ত  বন্ধন মুক্তি দিয়েছিল,  সেদিনই ঠিক করেছিল একাই চলবে বাকি জীবন। নিজের ওপর অনেক কষ্টে বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে আবার চাকরি খুঁজে নিজেকে শক্ত পায়ে দাঁড় করিয়েছিল।গত কয়েক বছর লোকসমাজের অন্তরালে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে নিজেকে। ডিভোর্সি মেয়েদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার হাজারো জ্বালা।কেউ রেহাই দেয়না। নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন থেকে শুরু করে আত্মীয়- বন্ধু- প্রতিবেশী -অফিসকর্মী, কেউ না। প্রেম করে বিয়ে প্রথম অপরাধ, ডিভোর্স দ্বিতীয় অপরাধ। তাই বাড়ির চেনা পরিবেশ থেকে বহুদূরে পালিয়ে এসে নিজের মত একার পৃথিবীতে থাকে তৃষা। হঠাৎ তাই ধূমকেতুর মত শুভর আগমন মনটাকে অনেকটাই এলোমেলো করে দিলেও নিজেকে শক্ত রাখতে শিখে গেছে। আজ তাই কঠিন হতেই হল ।

দীপ্ত খাওয়া বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। যেন উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছে। অপরিণত মন এইসব ভাবেইনি কখনো। চোখ নামিয়ে নিল। তৃষার দিকে তাকাতেও যেন সাহস হচ্ছে না আর। এই তৃষাকে যেন সে চেনে না। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বলল। আস্তে আস্তে বলল, “ জানি না ।ভাবিনি কখনো এইভাবে। ক্ষমা করে দে। “

তৃষা জানত উত্তর এটাই হবে। ও দীপ্তর মাথায় হাত দিল। বলল, “ লজ্জা পাচ্ছিস কেন? কিছু অন্যায় তো করিস নি তুই। শুধু বাস্তবটা ভুলে গেছিলি। ওটাকে যে অবহেলা করা যায় না দীপ্ত। আমি এত বড় অন্যায়টা তোর সাথে কি করে করি বল? তোকে তোর পরিবার থেকে আলাদা করে দিলে নাতো তুই ভালো থাকবি, না আমি। তাহলে আবার সেই অশান্তি, সেই ডিভোর্স? বাদ দে এসব। দিব্যি তো বন্ধু আছি আমরা। এরকমই থাকব।সারাজীবন। কম নাকি রে? এখন খেয়ে নে। “ দীপ্তর মুখটা তুলে ধরে দুহাতে তৃষা। দেখে চোখ ভর্তি জল। আলতো হাতে মুছিয়ে দেয়। বাকি খানিকটা খাবার নিজে হাতে মুখে তুলে দেয়। দীপ্ত মুখ নাড়তেও পারেনা। বড্ড তেতো লাগছে যেন বিরিয়ানিটা। বোঝে তৃষা।কিন্তু এছাড়া উপায় ছিলনা যে আর।  

সন্ধ্যাবেলা বাড়ি যাওয়ার সময় দীপ্তর টেবিলে গিয়ে তৃষা জানলো দীপ্ত খানিকক্ষণ আগেই বাড়ি চলে গেছে।সাধারণত রোজ একসাথে খানিকটা পথ যায়, তারপর দুজন দু’দিকে চলে যায়। আজ দীপ্তর এই ব্যবহারের কারণ বুঝল তৃষা। কষ্টও হল খুব। মনে হল এতোটা কঠোর না হলেও চলত। ছেলেমানুষ, নিজেই হয়ত একদিন বুঝে যেত। কিন্তু ইদানিং বড্ড পাগলামি করছিল দীপ্ত। প্রাকৃতিক চাহিদাগুলো হয়ত দমন করা সম্ভব হচ্ছিল না ওর পক্ষে। বারবার জিজ্ঞাসা করত,” তোকে কোনওদিন পাবো আমি? আমার হবি তুই?” ছেলেখেলায় জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের আড়ালে থাকা অর্থ বুঝতে অসুবিধা হত না তৃষার। নরম স্বভাবের মেয়ে তৃষা, কাউকেই কখনো মুখের ওপর না বলতে না পারা মেয়ে তৃষা, ভুক্তভোগী, যন্ত্রণায় বিদ্ধ শরীরে মনে অজস্র দগদগে ঘা নিয়ে বেঁচে থাকা মেয়ে তৃষা। শুভর মুখের ওপরও না বলতে পারেনি। বা স্বীকারও করতে পারেনি নিজের শিকলে বেঁধে রাখা চোরাস্রোতের কথা, ভালো বন্ধু হারানোর ভয়ে। আজ কেন জানি মনে হল হারিয়েই গেল আরও এক বন্ধু।নিজের ওপর রাগ হল খুব। কি দরকার ছিল এত কঠিন কথাটা বলার?    

রাতে বাড়ি ফিরে না খেয়েই শুয়ে পড়ল তৃষা। ঘুম এলো না। এক অস্থির বিনিদ্র রজনীযাপন।বারবার হাতে ফোন তুলে নিল। চাইল একটু কথা বলতে।অজানা ভয়ে পারল না।  বারবার চাইল একবার ফোন করুক দীপ্ত। কথা বললেই ঠিক হয়ে যাবে সব। হঠাৎ ফোনের আলো জ্বলে ওঠে। দীপ্তর কথা ভেসে ওঠে।

“ক্ষমা করে দিস আমায়। আমি সত্যিই পারব না এতো বড় কাজ করতে। সাহস নেই আমার।আর তোকে কোনোদিনও বিরক্ত করব না আমি।“

তৃষ্ণার চোখের কোণ গড়িয়ে জল বেয়ে যায়।উত্তর দেয়, “ ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই দীপ্ত। বাস্তবটা বড্ড কঠিন রে। আমি জানি। তুইও জানবি। আরো একটু বড় হয়ে যা। আজ হয়ত আমাকে খুব কঠোর লাগছে, একদিন বুঝবি আমি ভুল বলিনি। যাইহোক। কাল দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খেতে আসিস তো । আমি একটা জিনিস বানিয়ে নিয়ে যাবো। তোর খুব প্রিয়।“

“ নারে কাল আমি একটু ব্যাস্ত থাকব। তুই অপেক্ষা করিস না। আমার খাবারও আনিস না। কাল হয়ত দেখাও হবে না।“

তৃষা বোঝে লজ্জায় পালাতে চাইছে দীপ্ত। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলে “ ওহে লজ্জাবৎ পুরুষ। কিছুই তো হয়নি।কেন পাগলামো করছিস? আজ চলেই বা গেলি কেন? এই রকম করিস না। আর তুই তো কথা দিয়েছিলি আর কিছু হোক না হোক, আমরা বন্ধু থাকবোই থাকবো। ভুলাক্কার। ভুলে গেছিস? চলে আসিস খেতে। ”

“ নারে বাদ দে। কাল সময় হবে না” দীপ্তর কথা ভেসে ওঠে।

তৃষা আর থাকতে না পেরে ফোন করে ফেলে। ফোন কেটে দেয় দীপ্ত। তৃষা অনুরোধ করে, “ একবার কথা বল। কিছু হয়নি তো।“

দীপ্তর জবাব আসে, “ এখন থাক। পরে কথা বলব। এখন ভালো লাগছেনা।“

তৃষা জোর করে না আর। মেনে নেয়। সময় দেওয়া দরকার বোঝে সেটা।

এক সপ্তাহ এই ভাবেই কেটে যায়। দীপ্ত আর দেখাই করতে চায় না।অফিসে হঠাৎ মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলেও এড়িয়ে যায়। ব্যস্ততার আড়ালে লুকিয়ে রাখে নিজেকে। তৃষা দেখে দুপুরে অন্যদের সাথে খেতে যায় দীপ্ত।কয়েকবার এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে চেয়েও বিফল হয়ে ফিরে আসে তৃষা। এরপর আর চেষ্টা করেনা কথা বলার। শুধু গলার কাছের কান্নার দলাটা জল দিয়ে গিলে ফেলে।

 

 মাসখানেক পরে এক রাতে ফোনে ভেসে ওঠে দীপ্তর কথা।

“তোকে জানানো হয়নি। আজ আমার শেষদিন ছিল অফিসে। আমি অন্য কোম্পানিতে চলে যাচ্ছি। অন্য শহরে। পরে এলে তোর সাথে দেখা করব।আজ ব্যস্ত ছিলাম, কিছু মনে করবি না আশা করি।“

দুজনের বিভাগ আলাদা বলে খবরটা পায়নি তৃষা।বাষ্পভরা চোখে কোনো রকমে উত্তর দেয়, “সাবধানে থাকিস। ভালো থাকিস।“

কেন জানি আজ এক অবোধ অভিমানে কষ্টে অপমানে শিশু হয়ে যেতে ইচ্ছা করে তৃষার।আরেকবার হেরে যাওয়ার গ্লানি সব কিছু মিথ্যা করে দেয়। ফোন থেকে দীপ্তর নম্বরটা মুছে ফেলার আগে নম্বরটা ব্লক করে দেয়। ফোনটা বন্ধ করে বিছানার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টি নামে। তৃষা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের জল বৃষ্টির জলে ভেসে সারা শরীর ভিজিয়ে দেয়। আজ বহুদিন পর বহুদিনের আটকে রাখা কষ্টগুলো গলা চিরে বেড়িয়ে আসে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার আগে তৃষার কানে দীপ্তর গলা ভেসে আসে “ কোনও দিনও তোকে ছেড়ে যাবো না। তোকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না। সারাজীবন বন্ধু থাকবো।“

 তৃষা অভিযোগ জানাতে পারেনা। “ তুই কেন একটু আলাদা হলি না দীপ্ত? তুই কেন একটু ভাবতে পারলি না আমার কথা? কিছুই তো চাইনি আমি। শুধু কি নিজেকে দিতে পারলাম না, এটাই অপরাধ। বন্ধুত্বটা নষ্ট করে দিলি? কেন ? কথা দিয়েছিলি কেন তবে?”

নিঃশব্দ হয়ে যায় তৃষা।মনে মনে বলে “আমার চোখের জলের দাম যেন তোকে দিতে না হয়। সত্যিই ভালো থাকিস।“ তৃষা জানে “কেউ কথা রাখে না… “। প্রতিজ্ঞা তো করাই হয় ভেঙ্গে ফেলার জন্য। বন্ধুরাও হারিয়ে যায় নিজেদের পাওনা আদায় না করতে পারার জন্য।এটাই কঠোর বাস্তব।

                                                                      

 চিত্র সৌজন্যঃ https://steemit.com/ 

0 Comments

আপনার বক্তব্য