প্রসব পরবর্তী মানসিক অবসাদ বা পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন

প্রসব পরবর্তী মানসিক অবসাদ বা পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন ঃ 

 ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ব্রাক্ষনবাড়িয়ার এক মা তার ৪ দিন বয়সী বাচ্চাটিকে ক্লিনিকের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করার পর নিজেও আত্মহত্যা করেছিলেন । ক্লিনিকের বিল পরিশোধ করা সংক্রান্ত কারন এবং পারিবারিক অশান্তি মূল কারণ হিসাবে প্রকাশ পেলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা একে  পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বলে  চিহ্নিত করেন ।

২৮ জানুয়ারি ২০২০  তারিখে  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  কলকাতার একটি সংবাদ ভেসে বেড়াচ্ছিল । ৩৫ বছর বয়স্ক এক মা তার  ২ মাস বয়সী শিশু কন্যাকে হত্যা করেছে। তাঁর মতে তিনি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলেন এবং বাচ্চাটিকে তার আর সহ্য হচ্ছিল না। এক্ষেত্রেও চিকিৎসকেরা মায়ের পোস্ট  পার্টাম ডিপ্রেশন কে কারণ বলে অভিহিত করেন। 

প্রসব পরবর্তী মানসিক অবসাদঃ
নারী পূর্ণতা পায় মাতৃত্বে। প্রতিটি নারীর বড় আখাঙ্খার বস্তু মাতৃত্ব। কিন্তু সন্তানধারণের সাথে সাথে একজন নারীর শরীরে ও মনে শুরু হয় বহুবিধ পরিবর্তন। প্রসব পরবর্তী সময়েও বহুক্ষেত্রে শারীরিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এসবই আমাদের জ্ঞাতব্য। কিন্তু প্রায় ১৫% নারী প্রসব পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রকারের মানসিক অসুস্থতার শিকার হন। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের অজানা থেকে যায়।মূলত ভারতীয় উপ মহাদেশে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে এখনও পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব এক্ষেত্রে দায়ী।প্রসব পরবর্তী অবসাদ বা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন (post partum depression) বা পোস্ট পার্টাম বাই পোলার ডিপ্রেশন এর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে প্রায় ৭০-৮০% মহিলা প্রসবের পরে মানসিক অসুস্থতার শিকার হন।
যে কোনো নতুন মায়েরই এই সমস্যা হতে পারে। সন্তান জন্মের ২ /৩ দিন থেকে শুরু করে ৭/৮ দিন অবধি নতুন মায়েরা মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হন। একে “বেবি ব্লুস” বলা হয়। এই অবস্থা সাধারণত ১২/১৫  দিন পরে স্বাভাবিক ভাবেই ঠিক হয়ে যায়।এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক এক ঘটনা। বাচ্চার জন্মের ঠিক পরের মুহূর্ত থেকে পরবর্তী ছয় সপ্তাহ সময়কালকে পোস্ট-পার্টাম বা প্রসবোত্তর পর্ব হিসেবে ধরা হয়। প্রসবের পরের এক সপ্তাহে হরমোনের প্রভাব ও মানসিক ভাবে একজন মায়ের অনুভূতিগত আচরণে কিছু তারতম্য লক্ষ করা যায়। বেশিরভাগ মা এই সময় অতিরিক্ত আবেগান্বিত এবং অবসাদে ভুগতে থাকেন। এছাড়া হঠাৎ কেঁদে ফেলা, খিটখিট করা, অযথা উদ্বিগ্নতা, খিদে কমে যাওয়া, মাথা ব্যথা বা ভুলে যাওয়ার মতো সমস্যায় পড়েন। এগুলিই মূলত পোস্ট-পার্টাম ব্লুজ-এর লক্ষণ। এটি স্বাভাবিক এবং সাময়িক সমস্যা।

 কিন্তু যদি অবসাদ দুই সপ্তাহের পরেও স্থায়ী থেকে যায় তাকে  প্রসব পরবর্তী অবসাদ বা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন হিসাবে গণ্য করা হয়।এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এই অবসাদ চরম পরিনতি ডেকে আনে।  

চিত্র সৌজন্যঃ গুগল

বাইপোলার ডিসঅর্ডার / ডিপ্রেসন কি ?

বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা ডিপ্রেশন  হল একধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় বিশেষ অবস্থা, যে অবস্থায় ব্যক্তির মেজাজের অস্বাভাবিক প্রকারের পরিবর্তন ঘটে। তা আনন্দ বা বিষণ্ণতা যে কোনও ধরনের হতে পারে। এরফলে ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রসবপরবর্তী বাইপোলার ডিসঅর্ডারঃ

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতি পাঁচজন মায়ের মধ্যে একজন প্রসব পরবর্তী বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হন।সাধারণত প্রসবের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এর লক্ষণ ফুটে ওঠে। পরবর্তীসময়ে ছয় থেকে আট সপ্তাহের ভিতর এই অসুখের তীব্ররূপ ধরা পড়ে। যদিও এর সঠিক কারণ এখনও নির্ধারণ করা যায়নি তবুও এর কিছু কারণ বলা হয়ে থাকে।

                        চিত্র সৌজন্যঃ গুগল 
কারণসমুহঃ

১) গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন, শারীরিক পরিবর্তনঃ গর্ভবতী থাকাকালীন একজন নারীর হঠাৎ যে হরমোনজনিত পরিবর্তন হয় । তৎসহ শারীরিক পরিবর্তনও মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে। সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পর যৌন হরমোন ও স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে, যার ফলে মস্তিষ্কের যে অংশ অনুভূতি ও সামাজিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশে বেশ পরিবর্তন হয় এবং উপসর্গগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। 

২) পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনঃ একটি শিশুর দায়িত্ব, তার লালন - পালন, রাতদিনের ব্যস্ততা, বিশ্রামহীনতা, ঘুমহীনতাও দায়ী হয়।

৩) সঠিক সাহায্যের অভাবঃ শিশুকে নিয়ে নাজেহাল মায়ের আনুসঙ্গিক কার্যাদি করার সহায়কের অভাব।

৪) প্রসবকালীন সমস্যাঃ প্রসবকালীন বিভিন্ন সমস্যা যেমন অসহনীয় ও দীর্ঘকালীন প্রসবযন্ত্রণা, হঠাৎ কোনও দুর্ঘটনায় শারীরিক অন্য জটিলতা, প্রসবকালীন জটিলতায় কষ্ট পাওয়া প্রভৃতি।

৫) জিনগত সমস্যাঃ সাধারণত বাইপোলার ডিসঅর্ডার জিনসুত্রে বাহিত হয় বলে ধারণা করা হয়। পরিবারে অন্যের এই সমস্যা থাকলে অনেক সময় তা জিনবাহিত হতে পারে।

৬) চাহিদা অনুযায়ী শিশুর জন্ম না হওয়াঃ অনেক সময় বিকলাঙ্গ - অসুস্থ শিশু, বা শিশুর গাত্রবর্ণ বা লিঙ্গ মায়ের চাহিদানুযায়ী না হলেও এই ব্যাধি দেখা যায়।

৭)মানসিক রোগগ্রস্থ হলেঃ নিজের কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে, বিশেষ করে মা নিজেই যদি বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হয়ে থাকেন।

৮) দাম্পত্য কলহঃ স্থায়ী ও দীর্ঘ কালীন দাম্পত্য কলহ থেকে এই অবসাদ তৈরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

৯) স্বজনহীনতাঃ পরিবার ও বন্ধুহীনতা, বা অসংবেদনশীল পরিবার  বা অসহানুভুতিশীল আত্মীয়পরিজনের দুর্ব্যবহার বা সাহায্য হীনতা থেকে গভীর অবসাদ জন্ম নেয়।

১০) সাম্প্রতিক মানসিক চাপঃ শিশুর জন্মের আগে থেকে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা থেকে  আভ্যন্তরীন বা বাহ্যিক মানসিক চাপ অবসাদ তৈরি করতে পারে।  

 

                                                                   চিত্র সৌজন্যঃ গুগল 

 লক্ষণসমুহঃ 

  • মায়ের বাচ্চার ক্ষতি করার চেষ্টা। বাচ্চার সাথে আবেগীয় কোনো বন্ধন তৈরি করতে না পারা। বাচ্চার প্রতি উদাসীন আচরন।
  • বিষণ্ণতা ও সময়ে অসময়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরা।
  • বাচ্চার লালন পালনের কথা ভেবে অযথা আতঙ্কিত থাকা।
  • চরম ক্লান্তি। দিনের বেশিরভাগ সময়েই ক্লান্তিতে অবসন্ন থাকা।
  • খুব দ্রুত মেজাজ পরিবর্তন হওয়া।চেহারার কোনো আবেগের অভিব্যক্তি ঘটবে না।হঠাৎ ক্ষোভ এবং রেগে যাওয়া। আবার হঠাৎ খুশিতে ঝলমল করা।
  • আগের মতো ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভব না করা।অকারণেই ভয় পাওয়া। মানসিক অস্থিরতা।
  • সিদ্ধান্ত না নিতে পারা।
  • সর্বক্ষণ মৃত্যু চিন্তা করা। আত্মহত্যার চেষ্টা করা। নিজেকে সবার কাছে অপ্রয়োজনীয় ভাবা।
  • নিদ্রাহীনতা।ঘুম প্রায় না হওয়া। অথচ সারাদিন ঘুম ঘুম ভাবে আছন্ন থাকা। 
  •  অজানা আতঙ্কে ভোগা এবং প্রায় সারাক্ষনই মাথাব্যথা করা।
  • নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকা ।
  • পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করা।অসামাজিকতা প্রকাশ পাওয়া। 
  •  অকারণেই  মন খারাপ করা।
  • বেশিরভাগ সময় বিষণ্ণ ও অবসাদে লিপ্ত থাকা।
  • কিছু মারাত্মক ক্ষেত্রে বিভ্রম (Hallucination) তৈরি হওয়া।
                            চিত্র সৌজন্যঃ গুগল

চিকিৎসা পদ্ধতিঃ 

মানসিক রোগ হিসাবে মনোবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা Postpartum Bipolar Depression / Disorder কে তুলমানুলকভাবে কঠিন ও জটিল রোগের অন্তর্ভুক্ত করলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা এই রোগকে নির্মূল করতে সক্ষম।

  • প্রথমেই বাড়ির লোকেদের মানসিকভাবে পাশে থাকা একান্তই কাম্য। বুঝতে হবে 'মা' সত্যিই রোগগ্রস্ত। অনেকেই এটিকে খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে অবহেলা করেন। রুগীর পরিচর্চার স্থানে তাঁকে কটুকথা বলা, দায়িত্বজ্ঞানহীন রূপে চিহ্নিত করা, মেজাজের পরিবর্তনকে তাঁর খেয়াল খুশি আখ্যা দিতে থাকেন। এই ধরনের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • নতুন মা যাতে যথেষ্ট বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য, প্রয়োজনীয় ঘুম থেকে বঞ্চিত না হন সে দিকে নজর দিতে হবে।
  • মানসিকভাবে তাঁকে সবসময় শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। যে সকল ঘটনা, কথা, বা কাজ যা তাঁকে বিব্রত করে, তা যাতে না ঘটে তার দিকে নজর দিতে হবে।
  • শিশুর সব দায়িত্ব মায়ের একার উপর না চাপিয়ে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে। অতিরিক্ত পরিমানে সাহচর্য এই সময় একজন মায়ের দরকার হয়। বিশেষ করে তিনিও যে সবার কাছে সমানভাবে সমাদৃত ও প্রয়োজনীয় এই বোধ দেওয়া একান্তই দরকার।
  • জরুরীক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধপত্রাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • সাইকোলজিকাল থেরাপি, সিবিটি এবং ইন্টারপার্সোনাল থেরাপিও খুব উপযোগী। 
  • বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাউন্সিলিং প্রয়োজন। অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়া উচিত।
                                                চিত্র সৌজন্যঃ গুগল 

*** এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল গর্ভবতী থাকাকালীন চিকিৎসকের উচিত এই বিষয়ে জানান। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলির ক্ষেত্রে এই বিষয়ে অসচেতনতা ও  অজ্ঞানতাই মা ও সদ্যজাতকে ভয়ংকর ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। তাই সঠিক সময়ে যদি সজাগ করা যায় তাহলে অনেক প্রাণ বেঁচে যেতে পারে। সাথে অনেক পরিবারও।

চিকিৎসা গ্রহণ করলে মারাত্মক লক্ষণগুলো ২ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে চলে যায় এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হতে ৬-১২ মাস সময় লেগে যেতে পারে। যত দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে সুস্থতা আসবে তত দ্রুত আসে। তাই লক্ষণ প্রকট হলে অবহেলা না করে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই কাম্য। মা এবং সন্তানের স্বর্গীয় সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে সচেতন হতে হবে সকলকে। অবহেলা ও অনাদরে মৃত্যু ঘটে অনেক মায়ের ও নবজাতকের। তাই পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতাই পারে মা ও সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।

 ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। 🍀


0 Comments

আপনার বক্তব্য