আঁশটে গন্ধটা
লেখিকা -- শ্বেতলীনা
এ যেন বিনা
মেঘে বজ্রপাত। মোহরের কাছে মুহূর্তে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়। হাতে ধরে রাখা চায়ের
কাপটা ঠকাস করে কাচের টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করে, “ সঞ্জয়মামা?
তুমি সঞ্জয়মামাকে নেমন্তন্ন করেছো নাকি?”
পেপার পড়তে
ব্যস্ত বাবা মোহরের দিকে না তাকিয়েই বলেন, “হ্যাঁ বলেছি তো।তবে অতদুরে ওর বাড়ি গিয়ে
বলতে পারিনি।কার্ডটা পোস্ট করে দিয়েছিলাম।কাল নাকি পেয়েছে। তাই ফোন করে বলল আসবে।
“
মোহর বুকের
মধ্যে দ্রুত দামামার আওয়াজ শুনতে পায়। কাঁপা গলায় বলে, “ কেন বলেছ? একবারও বলোনি তো
এর আগে যে ওকে নেমন্তন্ন করবে?”
মোহরের বাবা
এবারও না তাকিয়েই জবাব দেন, “খেয়াল করিনি হয়ত তোকে বলতে। আর বলব নাই বা কেন? ওকি বাড়ির
বাইরের লোক নাকি? বাদ দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?”
মোহর আর যেন
আটকাতে পারেনা নিজেকে , একটু চিৎকারই করে ফেলে এবার, “ একবার জানাবে না আমাকে? কি দরকার
ছিল ওকে বলার?”
এবার মোহরের
মা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসে উত্তর দেন ,” তোর হলটা কি হঠাৎ? সঞ্জয়কে ডাকা হয়েছে বলে
এতো কথার কি আছে? তোকে ছোট থেকে কত্ত ভালোবাসে। ওর কোলে কোলেই তোর আধা ছোটবেলাটা কেটে
গেছিল। তোর তো সব আব্দারের জায়গা ছিল ওই এক সঞ্জয়মামা। জানিস কাল কত্ত খুশি হয়েছে তোর
বিয়ের খবর শুনে। “
মোহর ঝাঁঝিয়ে
উঠে বলে ,”কে কখন কাকে কত্ত ভালোবাসত না বাসত , কে কোলে নিয়ে কত্ত ঘুরত না ঘুরত তা
মনে রাখার দরকার নেই আমার, মা। কিন্তু যার সাথে গত সাত -আট বছর একটা কথা পর্যন্ত হয়নি,
কোনো যোগাযোগ নেই ,তাঁকে ডাকার কথা মাথায় এলো কি করে? আর ঠিকানাই বা পেলে কোথায়? ”
এবার বাবা বললেন, “ ঠিকানা তো তোর মামুর কাছেই ছিল। ফোন নম্বরও
। আর ব্যস্ততার জন্য যোগাযোগটা নষ্ট হয়ে গেছিল বলে তোর বিয়েতে বলব না ? এটা কিরকম কথা?
ভুলে তো আর যাইনি, সম্পর্কও নষ্ট হয় নি। এতো আনন্দের একটা ব্যাপার, ওকে তো বলতেই হবে?”
মা ও বলে ওঠেন
, “ তুই ই বা এটা নিয়ে সকালবেলা ঝামেলা শুরু করলি কেন ? আশ্চর্য তো! আমরা তো কাল রাতে
ভাবলাম খবরটা পেয়ে তুই খুব খুশি হবি। হলোটা কি শুনি? “
মোহর আর কথা
বলতে পারেনা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছে এক মুহূর্তেই। শুধু বিড়বিড়
করতে থাকে , “ তোমরা বুঝবে না।এ হতে পারেনা। “
নিজের ঘরে গিয়ে
দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ে আবার। কাঁপুনিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কুঁচকে দলা পাকিয়ে
বালিশে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এক তীব্র যন্ত্রণা মাথা থেকে ঘাড় বেয়ে কোমর থেকে
পায়ের দিকে নেমে যেতে থাকে।এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, বহুবছর আগের একটা দুপুর ও আরও কিছু
দিন রাতের বিভীষিকাময় সময় যেন পাকে পাকে জড়িয়ে ধরতে থাকে মোহরকে। একটা আঁশটে গন্ধ
, সেই পুরনো দিনের থেকে ভেসে এসে ঘরময় করে তোলে। হঠাৎ বমি উঠে আসে গলায়, মোহর ছুটে
বাথরুমে চলে যায়। সারা শরীর গুলিয়ে বমি করতে থাকে। তেতো হয়ে যায় মুখ, গলা।
বাইরে থেকে
মায়ের উদ্বিগ্ন গলার স্বর শুনতে পায়। “ কি হলো তোর? মোহর , শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
মোহর তখন জলের ঝর্ণার তলায় নিজেকে ধুতে ব্যস্ত। জোরে জোরে সারা শরীরে আঁচর কেটে যেন
গায়ের চামড়া তুলে ফেলবে, এমনভাবে জল দিয়ে ধুয়েই চলেছে নিজেকে।
অনেক কষ্টে
নিজেকে তৈরি করে অফিসের জন্য রওনা দেয়। সারা রাস্তায় একটা ভয়, ত্রাস, শরীর খারাপ লাগা,
গা গুলিয়ে ওঠা নিয়ে অফিসে ঢোকে। শেষদিন । তাই বিদায় সম্বর্ধনার কিছু আয়োজন ছিল বিকালের
দিকে। কিন্তু মোহর আর বেশি সময় থাকতে পারেনা। সবাই কথা বলতে আসছে। বিদায়ের আগের কথাবার্তা।
কিন্তু মোহর পারেনা কোন কিছুই ঠিকভাবে বলতে বা করতে। কোনওমতে অফিসের প্রয়োজনীয় বিধি
মিটিয়ে অসুস্থতার অজুহাতে তাড়াতাড়ি বাড়ির জন্য বেড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু বাড়ি
ফিরতেও আজ আর মন চাইছে না। ধীর পায়ে বাড়ির উল্টোদিকের বাসে উঠে বসে। মাথার মধ্যে ঘুরে
ফিরে আসতে থাকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা মুহূর্ত গুলো। হঠাৎ কন্ডাক্টরের ডাকে হুঁশ ফিরে পায়।
টিকিট কাটার জন্য কোথায় যাবে জানতে চাইলে মোহর তাকিয়ে দেখে আশপাশটা। ফাঁকা একটা মাঠের
পাশ দিয়ে বাস যাচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি ওইখানের একটা টিকিট কেটে নেমে পড়ে। সামনের মাঠের এক
কোণে একটা বকুলফুলের গাছের নীচে বাঁধাই করা চাতালে গিয়ে বসে পড়ে। চোখের জলে চারিদিক
আবছা হয়ে আসে। সব মুছে গিয়ে ষোল বছর আগের এক দুপুরে অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে মোহরকে
দাঁড় করিয়ে দেয়।
মাত্র আট বছরের
মোহর। আগেরদিন বিকালে বাড়িতে দিম্মা আর সঞ্জয়মামা এসেছে। সঞ্জয়মামা। মামুর সবথেকে ঘনিষ্ঠ
বন্ধু। মোহর অবশ্য তখনও অত বুঝত না আপন পরের ব্যাপার স্যাপার। সঞ্জয়মামা। যে কিনা বিনা
বাক্যব্যয়ে মোহরের সব আবদার মেটাত সেই ছোট থেকে। জ্ঞানত মোহর মামাবাড়ি গেলেই দেখতে
পেত সঞ্জয়মামাকে। সেই সঞ্জয়মামা আর দিম্মা আসার আনন্দে বিভোর মোহর সারাদিন হুল্লোড়ের
পর দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল সঞ্জয়মামার কোলেই। শীতকাল।লেপের তলায় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল
এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে। অন্য ঘরে মা আর দিম্মার গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। কিন্তু ও বুঝতে
পারছে না কি যেন একটা ওর হাতের মধ্যে ধরা। তখনও ঘুম কাটেনি ঠিক করে। তাও চোখ খুলে ফেলে।
দেখে পাশে শুয়ে থাকা সঞ্জয়মামার একটা হাতের
মধ্যে ওর একটা হাত আর দুই হাতের মধ্যে চেপে ধরা আছে সঞ্জয়মামার গোপনাঙ্গ।ভয়ে কাঁটা
হয়ে যায় মোহর।বড় বড় করে তাকিয়ে দেখে চোখ বন্ধ করে সঞ্জয়মামা ওর হাত জোর করে চেপে ধরে
নিজের শরীরে ঘসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় মোহরের। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝে ওঠার আগেই হাত ভর্তি
হয়ে যায় কোনও এক তরল আঠালো জিনিসে।এবার কেন জানি মনে হয় অন্যায় হচ্ছে কিছু, নিজের হাত
সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। টান মেরে হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় সঞ্জয়মামা চোখ খুলে ফেলে ওর
দিকে তাকায়। নিজের লুঙ্গিতে ওর হাত মুছিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলে,” যা হাতটা ধুয়ে
ফেল। আর কাউকে বলবি না এটার কথা। এটা তোর আর আমার সিক্রেট। বললে তোকেই মা মারবে।“
ছাড়া পেয়ে লাফ
দিয়ে বিছানা থেকে নেমে হাত ধুতে চলে যায়।জলের তলায় হাত ধরতেই একটা বিশ্রী আঁশটে গন্ধ
পায়। গা গুলিয়ে ওঠে। বুকের মধ্যে তখনও দুমদুম করে যেন দামামা বাজছে। সাবান দিয়ে হাত
ধুতে থাকে। একবার, দুবার, তিনবার। কিন্তু কিছুতেই যেন গন্ধটা যায় না। বাথরুম থেকে বেড়িয়ে
সোজা দিম্মার কাছে গিয়ে কোল ঘেঁষে বসে পড়ে। দেখে ওখানে এখন চায়ের আসর বসেছে। সঞ্জয়মামা
দিব্যি নিশ্চিন্তে হেসে হেসে মা আর দিম্মার সাথে গল্প করছে। মোহরকে দেখে একটা অদ্ভুত
হাসি হাসে । যেন গোপন আনন্দের ভাগিদার মোহর। ভয়ে একটা কাঁপুনি শুরু হয় মোহরের।ডিসেম্বর
মাসের ঠাণ্ডাতেও ঘামতে শুরু করে। কিন্তু কেউ জানতে পারেনা। কাউকে কিছু বলতে পারেনা।
মার খাওয়ার ভয়ে। ঠাকুরকে ডাকতে থাকে কবে কালকের সকালটা আসবে। ভোরেই যে সঞ্জয়মামার বাড়ি
ফিরে যাওয়ার কথা। সেদিন রাতে খেতে পারেনা।সারাক্ষণ হাতে বিশ্রী গন্ধটা পায়। বারবার
বাথরুম যায় আর সাবান দিয়ে হাত ধুতে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটে যায় পাশের ঘরে।
দেখে সঞ্জয়মামা চলে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেও মোহরের ভেতর বাসা বাঁধে এক অজানা
আতঙ্ক। কিন্তু ছোট্ট অবুঝ মন জানতেও পারেনা কি ঘটে গেল বা আগামী দিনে কি ঘটতে চলেছে।
ভাবতে ভাবতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল মোহর। কাঁধে একটা
স্পর্শ পেয়ে চমকে প্রায় লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায়। দেখে পাশে বসে একজন ভদ্রমহিলা। বলছেন,
“ আপনার ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। শুনতে পান নি বোধহয়। তাই ডাকলাম। শরীর কি খারাপ
লাগছে। আপনাকে দেখে সুস্থ মনে হচ্ছে না। “ ঘোর কাটিয়ে আবার নিজের বর্তমানে ফিরে আসে
মোহর।দেখে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, আর কোনও উত্তর না দিয়ে
বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। ফোনটা ব্যাগ থেকে বার
করে দেখে রক্তিম, বাবা, মা , ভাইয়ের মিলিত অজস্র মিসড কল। তাড়াতাড়ি বাড়িতে মাকে ফোন
করে। বলে রাস্তায় আছে ফিরছে। রক্তিমকে ফোন করে জানায় বাড়ি ফিরে কথা বলবে।
বাড়ি ফিরে আসে।
কিন্তু স্বাভাবিক হয়না। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে একই জিনিস। রাতে রক্তিমকে ফোন করে।
কিন্তু কথা বলতে পারেনা ঠিক করে। বহুবছরের সম্পর্ক ওদের। রক্তিমের কাছে লুকাতে পারেনা।
গলার আওয়াজ শুনেই জিজ্ঞাসা করে রক্তিম, “ কি হয়েছে? সব ঠিক আছে? সারাদিন একবারও আজ
ফোন করনি।বেশ চিন্তায় ছিলাম। অফিসে ব্যস্ত ছিলে ? শরীর ঠিক আছে?” এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা
করেও ব্যর্থ হয় মোহর। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত, বিধ্বস্থ মোহর কোনো রকমে বলে, “ বাবা
সঞ্জয়মামাকে নেমন্তন্ন করেছে। বিয়েতে নাকি সবাই ওরা আসবে। সকালে জানলাম। “এইটুকু বলেই
হাঁফাতে থাকে মোহর।দম আটকে আসছে যেন ওর। রক্তিম প্রথমে বুঝতে পারেনা। তারপর মনে পড়ে
যায়। বুঝতে পারে মোহরের কথার মানে। রক্তিম জানে সবকিছু। মোহর সম্পর্কের শুরুতেই সব
জানিয়েছিল। মিথ্যার আড়ালে নতুন সম্পর্ক শুরু করতে চায়নি । রক্তিম পরম বিশ্বাসে, ভালোবাসায়
কাছে টেনে নিয়েছিল মোহরকে।যে যন্ত্রণা মোহর একা বয়ে নিয়ে চলেছিল তেরো বছর ধরে, তা ভাগ
করার ফলে যেন বুকের মধ্যে চেপে বসে থাকা যন্ত্রণাটা একটু কম মনে হয়েছিল।
রক্তিম কথার
সুত্র ধরে বলে, “ আসবে তো কি হয়েছে? তুমি তোমার মত থাকবে। ওনার সামনে না গেলেই তো হল।
বুঝতে পারছি একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। “
মোহর আর্তনাদ
করে ওঠে। “ না না না। তুমি কিছু বুঝতে পারছো না। অস্বস্তি নয়। ঘেন্না ঘেন্না। এটা হতে
পারেনা। আমি চাইনা আসুক ওই লোক টা। কিছুতেই না।নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, পারব না।“
কথা বলার মাঝে
মোহরের মা ঘরে আসেন। হেসে হেসে বলেন ,” তুই অফিসে ছিলি যখন সঞ্জয় ফোন করেছিল। জিজ্ঞাসা
করছিল তোর পছন্দের গয়না কি? কি পড়তে তুই সবথেকে ভালোবাসিস? আমি তোর নম্বরটা দিয়ে দিয়েছি।
বলেছি তোকেই জিজ্ঞাসা করে নিতে। কত ভালোবাসে দেখ তোকে। আর তুই সেই সকাল থেকে এই নিয়ে
কি এক অশান্তি করে চলেছিস।একটু পরে তোকে ফোন করবে হয়ত। “
কথা শুনেই মাথায়
রক্ত জমে যায় মোহরের। চিৎকার করতে থাকে পাগলের মত, “ কেন দিয়েছ আমার নম্বর? আমাকে এটাও
জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই কি? কে হই আমি ওর? আমাকে গয়না দেবে কেন? কিসের এতো ভালোবাসা?
“
মা থতমত খেয়ে
গিয়ে বকুনি দিয়ে বলেন , “ তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? হয়েছে টা কি? এই রকম কেন করছিস?
দিব্যি ভালো ছিলি সকাল থেকে কি পাগলামি শুরু করে দিলি? “
মোহর বলতে পারেনা
কিছু ।শুধু এক বুক তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে , “ তুমি যাও মা। আমাকে একটু একা থাকতে
দাও। “
ফোনে রক্তিম
সব শোনে। সব বোঝে। মা চলে যাওয়ার পর ফোন তুলে নেয় মোহর। শুধু কাঁদতে থাকে। কথা বলার
শক্তিটাও নেই আর। রক্তিম সান্তনা দেয়, “ ভুলে যাও মোহর। যত ভাববে তত তো তোমারই কষ্ট।
আজ কথা বলতে হবে না আর। ফোন অফ করে শুয়ে পর। আমি তোমার মাকে বলে দিচ্ছি আজ যেন কেউ
বিরক্ত না করেন। কাল সকালে কথা বলে ঠিক করব যা করার। কিন্তু নিজেকে শক্ত কর। সারাজীবন
তো এই ভাবে কষ্ট পেতে পারোনা।“
মোহর ঘর অন্ধকার
করে শুয়ে পড়ে। নিঃশেষিত আজ যেন, একটুও শক্তি নেই ওর শরীরে। অঝোরে কাঁদতে থাকে। সারাদিনের
ক্লান্তি দুচোখের পাতা ভারী করে দেয়। হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছিল। কিছু একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে
যায়। কটা বাজে বুঝতে পারেনা। খুব জল তেষ্টা পেয়েছে তাই উঠে জল নিয়ে এসে খায়। বসে থাকে
বিছানায়। সারা বাড়ি ঘুমে মগ্ন। ঘড়িতে রাত দুটো।ভারাক্রান্ত মনে শুয়ে পড়ে, ঘুমের চেষ্টায়
চোখ বন্ধ করতে যেতেই ছবির মত ভেসে ওঠে পঁচিশ বছরের জীবনের চরম লাঞ্ছনার, লজ্জার, যন্ত্রণার
দিনগুলো।
তখন মোহর সপ্তম
শ্রেনীর ছাত্রী। বয়েসের তুলনায় বরাবরই ওর চেহারা একটু বেশি পরিণত।বয়ঃসন্ধির চিহ্নগুলো
সেই সময়ই ওর অন্য বন্ধুদের তুলনায় একটু বেশি প্রকট। তাই নিয়ে নিজেই সবসময় লজ্জায় জড়সড়
থাকে। হঠাৎ একদিন রাতে বাবা অফিস থেকে ফিরে এলেন ওর দাদুর মৃত্যু সংবাদ সঙ্গে নিয়ে। তড়িঘড়ি কোনও রকমে ওরা
তৈরি হয়ে মামাবাড়ি চলে যায়। তারপর একটানা পনেরোদিন ওখানেই থাকা, যতদিন না শ্রাদ্ধকর্মাদি
শেষ হয়। ওরা পৌঁছানোর পরেরদিন ভোরেই সঞ্জয়মামা এসে হাজির।মামুর সাথে সাথে কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে সমস্ত কাজ করে চলেছে। বাড়ির সবাই অসম্ভব নির্ভরশীল। সব ব্যাপারে সঞ্জয়কে চাই।মোহর
সেই ঘটনার পর থেকেই একটু গুটিয়ে রাখত নিজেকে। কিন্তু সময় অসময়ে মামাবাড়ি গেলেই দেখা
হত, আর সুযোগ বুঝে জড়িয়ে জাপটে ধরে সবার সামনেই “কত্ত ভালোবাসে” তার বহিঃপ্রকাশ করতে
ভুলত না। কেউ ই এর মধ্যে কোনোদিনও কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পান নি। কিন্তু মোহর প্রতিবারই
পালিয়ে যাবার চেষ্টা করত, নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিত। লুকিয়ে পড়ত। এবার আর তা সম্ভব
ছিল না। মামাবাড়িতেই থেকে গেল সঞ্জয়মামা। প্রথম ধাক্কার শোক কাটিয়ে উঠেছে দু’-তিনদিন
হয়েছে।
জানুয়ারি মাসের
শীতের দুপুরে সব ভাই বোনরা একসাথে ঘুমাচ্ছে, হঠাৎ মোহর বিভীষিকা নিয়ে জেগে উঠলো। তাকিয়ে
দেখলো পাশে শুয়ে সঞ্জয়মামা। একটা বলিষ্ঠ হাত মোহরের সারা শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় মোহর বোবা হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগলো। কি করবে বুঝে ওঠার
আগেই ফিসফিসিয়ে কথা শুনতে পেল, “ তুই কত সুন্দর হয়ে গেছিস রে মোহর।কত বড় হয়ে গেছিস।“
বলেই ওকে আরও কাছে টেনে নিল। মোহর হুঁশ ফিরে পেয়েছে ততক্ষনে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা
শুরু করতেই শুনতে পেল, “ লাফালাফি করিস না। বাকিরা জেগে যাবে। “ পাশে ঘুমন্ত ছোট ভাইবোনেদের
দিকে ইঙ্গিত করে বলল সেই স্বর। মোহরকে চেপে ধরে নিজের শরীরের সাথে মেশাতে চাইল। মোহর
শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরের আভাস পেল এই প্রথম। কেঁদে ফেলল।তাতেই ছেড়ে দিল।উঠে চলে গেল।বলে
গেল সেই কথাগুলো,” কাউকে বলবি না।তোকেই খারাপ বলবে সবাই।“ কিন্তু মোহর সেই আঁশটে গন্ধ পেল। টের পেল বাকি অনেক
কিছুর। ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেল। একবার ভাবল উঠে গিয়ে মাকে বলে দেয় সব। কিন্তু অজানা ভয়ে
কিছু করতে পারল না। সেই শুরু । তারপর রোজ একবার দুবার সুযোগ পেলেই এই ঘটনা ঘটতে লাগলো।
অনেকবার চেষ্টা করেও মোহর কাউকে বলতে পারল না কাউকে কিছু। সবাই শোকে স্তব্ধ, মাঝে মাঝেই
কান্নার রোল উঠছে তখনও। জানত বললে বাড়িতে ঝড় উঠে যাবে। তাছাড়া সবসময় পাহারাদারি থাকত
যেন ওর ওপর।অগত্যা নিঃশব্দে টানা ক’দিন সেই যন্ত্রণা সহ্য করে গেল মোহর। সব কাজ শেষে
বাড়ি ফিরে এলো সবাই। এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ল মোহর। সারা শরীর জুড়ে আঁশটে গন্ধ।সাবান দিয়ে
ধুয়ে ধুয়েও যেন গন্ধ যেত না। খেতে বসলেই বমি শুরু হত। ঘুমাতে পাড়ত না। মাকে বলার চেষ্টা
করেও বলতে পারল না। সবাই ভাবল দাদুর শোকে এই অবস্থা।একমাস অসুস্থ থাকার পর ধীরে ধীরে
নিজেকে শক্ত করে তুলল।পড়াশোনায় নিজেকে ডুবিয়ে দিল। বোঝাল যেটা হয়েছে সেটা নিয়ে পড়ে
থাকলে ওর নিজেরই ক্ষতি।যোগাযোগ না হলেও খবর পেয়েছিল সঞ্জয়মামার বিয়ের এবং কন্যাসন্তান
জন্মের। একটি নয় দুটি কন্যার পিতা আজ সেই লোকটি, যে মোহরের শৈশব ও কৈশোরকে আঁশটে গন্ধে
ভরিয়ে দিয়েছিল।
বহুবছর পর আজ
সেই অতীত যেন ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। আবার সেই যন্ত্রণা শুরু হল মোহরের। সেই গন্ধ। কিন্তু
আজ হারবে না মোহর। বাকি রাতটা বসে বসেই কাটিয়ে দিল।
সকালে মা সঞ্জয়মামাকে
নিয়ে কিছু বলতে শুরু করতেই মোহর বলল , “ ফোন নম্বরটা দাও তো আমায়। আমিই কথা বলব।“
ফোন করল মোহর।
বাড়ির সবার সামনে। মোহরের গলার স্বর শুনেই উচ্ছসিত সঞ্জয়মামা।
“ বাব্বা তুইও
বড় হয়ে গেলি অ্যাঁ! তোর বিয়ে? আমি তো ভাবতেই পারছিনা। এই সেদিনের পুচকি মোহরের নাকি
বিয়ে? কি খবর বল? তোকে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে আছে। খালি ভাবছি কবে তোকে দেখতে পাবো।”
মোহর শান্ত
হয়ে সব শুনল। সঞ্জয়মামা থামতে মোহর ধীরে ধীরে বরফঠাণ্ডা গলায় বলল , “ আমার দুটো কথা
বলার ছিল তোমাকে। এক, আমার বিয়েতে তুমি আসবে
না। আমি আমার নতুন জীবনের শুরুর দিনটা তোমার মুখ দেখে শুরু করতে চাইনা। কারণটা তুমিও
ভোলনি আমিও না। খবরদার আসবে না আমার সামনে আর কোনওদিন।সেদিন যা পারিনি আজ সেটা আমি
পারব। ফলটা তোমা জন্য ভালো হবে না। দুই নিজের
দুই মেয়েকে সাবধানে রেখো, দেখো কোনও সঞ্জয়মামা যেন ওদের সর্বনাশ না করতে পারে, যে সর্বনাশটা
তুমি আমার করেছিলে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তোমার পাপের দাম যেন তোমার মেয়েদের
দিতে না হয়। “
শুধু ভয়ার্ত
নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া ওপার থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসে না আর।ফোনটা কেটে দেয় মোহর। বুকের
ওপর চেপে বসে থাকা অন্ধকার যন্ত্রণার পাথরটা আজ একেবারে উধাও হয়ে গেছে। খুব হালকা লাগে
নিজেকে। মনের মধ্যে আবার সেই খুশির হাওয়া। মায়ের হতভম্ব মুখের সামনে থেকে গুনগুন করে
গান গাইতে গাইতে ঘরে চলে গিয়ে রক্তিমকে ফোনটা করে ফেলে। হঠাৎ রজনীগন্ধার গন্ধ পায় যেন।
আঁশটে গন্ধটা একেবারে চলে গেছে। মোহর জানে ওটা আর কোনদিন ফিরে আসবে না।
0 Comments
আপনার বক্তব্য