যন্ত্রণা-মুক্তি


।। যন্ত্রণা-মুক্তি ।।

লেখিকা -- শ্বেতলীনা  




 

“আরে আর বলিস না। আজ আবার সেই LGBT দলের ধর্না আন্দোলন হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্লাসই হল না। এঁরা যে কেন এইভাবে ইউনিভার্সিটিতে ঝামেলা করছে বুঝিনা। নিজেদেরও ক্ষতি করছে, অন্যদেরও।“

“ হুঁ” বলে পলাশ চুপ করে গেল।

“প্রায়ই এক জিনিস হচ্ছে। ক্লাস নিতে না পারলে সিলেবাস শেষ হবেনা। ছেলে মেয়েগুলোর বেশ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ওঁদের দাবীগুলো ভুল না, ইউনিভার্সিটির ওপর মহল বলেছে ওঁদের দাবী নিয়ে আলোচনায় বসবে। তাও রোজ প্রায় এক ঝামেলা। শুনলাম সামনের সপ্তাহে মিছিল বার করবে।“  শ্রেয়া এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায়।

“ হুঁ” এবারও পলাশ এই টুকুই বলে।

“কি তখন থেকে ‘হুঁ,হুঁ’ করে যাচ্ছিস? কিছু বলবি তো নাকি?"  শ্রেয়া বলে।

“কি বলব? শুনছি তোর কথা। এতে বলার কি আছে?”

“ কেন তোর কোনো মতামত থাকতে নেই?”

“ আমার মতামত তোর হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে। তুই ওঁদের ব্যাপারে বেশ সহানুভূতিশীল।“ পলাশ একটু গম্ভীর।

“কথাটা সহানুভূতির নয়। তবে এটাও ঠিক ওঁদের দাবীগুলোর সব কটা না হোক কিছু অন্তত ন্যায্য।“

“ কিছুই ন্যায্য নয়। তোদের মত কিছু লোক এঁদের সমর্থন করে বলে সমাজে এই নোংরামি গুলো বাড়ছে। যতসব নোংরা বিকৃত মানসিক রোগগ্রস্ত লোকজন।ব্লাডি ক্রিমিনালস!পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেওয়া উচিত এদের। তা না , আলোচনা পর্যালোচনা। পুলিশের মার খেলে দুদিনে সব আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। সমাজটা একটু পরিষ্কার হবে।“ বেশ রেগে ক্ষিপ্ত হয়ে একটু উঁচু গলায় পলাশ বলে।

 “কি বলছিস তুই পলাশ?” কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় শ্রেয়া। এ কোন পলাশ? একে তো সে চেনে না। এতদিন কথা বলছে কোনোদিনও পলাশকে পিছিয়ে পরা মানসিকতার মনে হয়নি।কোনোদিনও একটা বাজে কথা বলেনি যে ছেলেটা সে আজ এই ভাষায় কথা বলছে শুনে প্রায় বাক্যহারা হয়ে যায় শ্রেয়া। 

“ঠিকই বলছি। তুই বেশী সহানুভূতি দেখাস না। এদের কথা শুনলে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাগে জ্বলতে থাকে। আমাকে ভণ্ড বা কপট ভাবতে পারিস। কিন্তু এদের প্রতি একবিন্দুও সহানুভূতি নেই আমার।“ পলাশ যেন রাগে কাঁপতে থাকে।

রোজ রাতের মতই আজও পলাশ শ্রেয়ার সাথে ফোনে কথা বলছিল। রোজ রাতে প্রায় সারে দশটা নাগাদ ওরা দুজন ফোনে কথা বলে। দুজন দুটো আলাদা শহরে থাকে। কেউ কাউকে আজ অবধি দেখেওনি। সামাজিক মাধ্যমে দুজনের পরিচয়। হঠাৎ করেই এক বন্ধুর মাধ্যমে আলাপ।কিছু পছন্দের বিষয় মিলে যায় দুজনেরই। সেই পছন্দের সূত্র ধরে কথা বলা শুরু। প্রথমে চ্যাট পরে ফোনে কথা বলা। ছ’মাসের মধ্যেই দুজনের সম্পর্ক অনেকটাই  ঘনিষ্ঠ হয়েছে । সারাদিনের অফিস বাড়ির কাজ সামলে দিনান্তে রোজ ওরা ঘণ্টা খানেক কথা বলে। দুজনেরই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। দেখা করার আশায় উদ্গ্রীব। দিন গুনছে কবে দেখা করতে পারবে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিনের একটা নিয়ম হয়ে গেছে যেন এই দুই অজানা অচেনা যুবক যুবতীর আড্ডা দেওয়ার। গল্পের বিষয়বস্তু রোজকার কাজকর্মের ফিরিস্তি দেওয়া থেকে শুরু করে গান, বই, সিনেমা হয়ে রাজনীতি বা দৈনন্দিন দেশের হাল হকিকত পর্যন্ত গড়ায়। ছুটির দিনের রাতগুলো তো অনেকদিন গল্প করতে করতে রাত কাবার হয়ে ভোর হয়ে যায়। দুজনেই নিজেদের অলখ্যে একটা ভাললাগার জগৎ তৈরি করে ফেলেছে, যেখানে শুধু ওদের হাসি আর ভালোলাগা , কান্না আর কষ্ট গুলো ভাগাভাগি হয়। সারাদিন ওরা দুজনেই অপেক্ষা করে থাকে এই রাত্রীকালীন আড্ডার জন্য। বাড়ির সবার অগোচরে একজোড়া কপোত-কপোতী যেন নিজেদের প্রিয়তম বাসা রচনা করে। শ্রেয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয় পলাশ, পলাশের খুনসুটিতে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে শ্রেয়া।শ্রেয়ার কথা বলার ভঙ্গীর তারিফ করে শ্রেয়াকে লজ্জায় রাঙা করে দেয় পলাশ। পলাশের সুদর্শন চেহারা আর মেঘগম্ভীর কণ্ঠের অফুরন্ত  প্রশংসায় পলাশকে বিব্রত করে শ্রেয়া।প্রায় সমবয়সী দুজন মানুষ ভুলে যায় সারাদিনের ক্লান্তি, বা অন্যান্য কষ্টের কথাগুলো।

আজ শনিবার।সাধারণত প্রতি শনিবারই কথা বলা রাত গড়িয়ে  ভোরের দিকে এগিয়ে যায়। আজ বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে কথা বলছে। শ্রেয়া ইউনিভার্সিটির লেকচারার। আজ সেই প্রসঙ্গেই কথা বলতে গিয়ে শ্রেয়া জানাল ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছুদিন ধরেই LGBT বিষয় নিয়ে একটা বিপ্লব ধরণের ব্যাপার দানা পাকাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পলাশের এই প্রতিক্রিয়া শ্রেয়াকে স্তব্ধ করে দেয়। যথেষ্ট প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচয় পলাশ দিয়েছে এতদিনের আলাপে। আজকের কথাগুলো তাই শ্রেয়ার কাছে বিনামেঘে বজ্রপাতের মত মনে হয়।

কিন্তু তাও নিজের বিশ্বাসকে এত সহজে নষ্ট না হতে দিয়ে পলাশকে বোঝানোর চেষ্টা করে ওঁদের ব্যাপারে। ওঁরাও মানুষ। আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। শুধু ওঁদের যৌন অনুভূতিগুলো একটু আলাদা। এটা মানসিক বিকৃতি নয়। অসুস্থতাও নয়। একটু অন্য ধরণের চাহিদা। যা সমাজের চোখে অস্বাভাবিক লাগে কারণ তথাকথিত সামাজিক ব্যবহারের সাথে মিল খায়না। আর কিছুই না।

“ তুই থামবি? তোর কি আর কিছু আজ বলার নেই? আমি এই নরকের কীটগুলোকে সজ্য করতে পারিনা।আর কিছু বলার না থাকলে ফোন রেখে দে।“ পলাশ এবার চিৎকার করে ওঠে।

এতদিনের আলাপে পলাশের এই ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে যায় শ্রেয়া। নিস্তব্ধতায় ভরে ওঠে। শ্রেয়া কথা বলে না আর। যেন চেনার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে নিজের জীবনের সব থেকে প্রিয় মানুষটাকে।এতদিন কি তবে সে ভুল চিনল। ভুল জানল। পলাশ এতো সংকীর্ণমনা?

নিস্তব্ধতায় পলাশ অনুভব করে শ্রেয়ার মনের অবস্থাটা। আস্তে আস্তে বলে ওঠে “আমার ভুল বুঝিস না । আমার এই রকম বলার বা ভাবার কারণ আছে রে। কিন্তু আমি সেটা বলতে পারব না। আজ অবধি কাউকেই বলতে পারিনি। জীবনের একটা যন্ত্রণাদায়ক দিন। যা রোজ আমায় পিছু তাড়া করে। জানিনা জীবনেও কোনোদিনও এর থেকে মুক্তি পাব কিনা। একটু বেশি বলে ফেলেছি ঠিকই তবে ওঁদের আমি ঘেন্না করি।এরপর তুই যা ভাবার ভাবতে পারিস।“

শ্রেয়া চুপ থাকে খানিকক্ষণ। তারপর বলে, “আমাকে বিশ্বাস করিস পলাশ? যদি করিস তাহলে আমায় বলতে পারবি না কি এমন ঘটনা যার জন্য তোর মত এত সুন্দর মনের মানুষের মন একটা সম্প্রদায়ের জন্য বিষিয়ে গেছে? আমাকে বলেই দেখ না। হয়ত মনটা হালকা হবে। তোর মতামত পাল্টাতে আমি বলবনা। কথা দিলাম।“

পলাশ অনেকক্ষণ চুপ থাকে। দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পায় শ্রেয়া। পলাশ বলতে শুরু করে, “আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। এক বছর আগে বাবা মারা গেছেন। তুই তো জানিস আমি কলকাতার ছেলে নই। তাই কলকাতায় ভর্তি হয়ে শুরুতেই হোস্টেলে জায়গা না পাওয়ার জন্য আমার মামারবাড়িতে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। মামা আমার কাছে বাবার পরেই স্থান পান। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মামাই আমাদের সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিপদের সময় সর্বক্ষণ আমাদের শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন। মামার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ।

ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার পর তাই মামা বললেন – 'যতদিন না হোস্টেল পাচ্ছিস, আমার বাড়িতেই থাকবি'। মামার বাড়িতে আমার মামাতো  দাদা সম্রাটের ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। সম্রাটদা আমার থেকে চার বছরের বড়। আমরা একসাথেই ঘুমাতাম। আমি বরাবরই একটু নরম স্বভাবের তুই জানিস। তখন বয়েস আরও কম, তার উপর বাবা মারা যাওয়াতে মানসিকভাবেও দুর্বল ছিলাম। মায়ের যাবতীয় দায়িত্ব আমার ওপর। কি ভাবে কতদিনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব সেই চিন্তাই সারাদিন মাথায় ঘুরত। মামাবাড়িতে সবার ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। সবাই আমাকে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু তবু মায়ের জন্য মন খারাপ হত।

একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা অজানা অস্বস্তিতে। কেউ যেন আমাকে খুব কঠিনভাবে জড়িয়ে ধরেছে। এক ঝটকায় জেগে উঠলাম। বুঝলাম সম্রাটদা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমার শরীরে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছে।কানের কাছে মুখ রেখে বলল –“ পলাশ তুই বড্ড সুন্দর রে! ভীষণ সুন্দর। তোকে আদর না করতে পারলে পাগল হয়ে যাব আমি।“

 আমি গায়ের জোরে ঠেলে সরাতে চাইলাম। কিন্তু আকস্মিক আঘাতে বল বা ঘুমন্ত অবস্থার জন্যই বল পারলাম না রে। শারীরিক দুর্বলতার থেকেও মানসিক দুর্বলতা আমাকে অক্ষম করে দিল। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে সাড়া জীবনের মত নোংরা করে দিল। ছাড়া পেয়ে আমি দৌড়ে বাথরুমে গেলাম। স্নান করতেই থাকলাম। সেই স্নান আমার আজও থামেনি শ্রেয়া।রোজ সাবান শ্যাম্পু দিয়ে ঘষে ঘষে স্নান করি জানিস। তবু মনে হয় সাড়া শরীর অপবিত্র কোনও জিনিসে চ্যাটচ্যাট করছে। অসম্ভব ঘেন্না হয় নিজেকে। কেন সেদিন এত দুর্বল হয়ে গেছিলাম, কেন সবাই কে চিৎকার করে জানালাম না? এই প্রশ্নগুলো সারাক্ষন মাথায় ঘুরতে থাকে। খুব কষ্ট হয় রে শ্রেয়া।মনে পড়লেই বুকের মধ্যে যেন রক্ত জমাট বেঁধে যায়। আজ অবধি কাউকে বলতে পারিনি । মনে হয় কাউকে বললে শুনতে হবে আমার দোষ। আমারও নিশ্চয়ই ইচ্ছা ছিল। বা অন্য কিছু কথা। এখনও প্রায় ন’বছর পরেও রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়ে আঁতকে উঠে ঘুম ভেঙ্গে যায়। শান্তিতে ঘুমাতে পারিনা কত বছর হয় গেল। অথচ ওঁকে দেখ কি সুন্দর  স্বাভাবিক আছে, আনন্দে আছে। একটু অপরাধবোধ অবধি নেই।আমি পালিয়ে বেড়াই ওর থেকে যাতে কখনো সামনা সামনি না হতে হয়। অজানা আতঙ্ক সব সময় পিছু তাড়া করে। আমার সারা শরীরে , মুখে, ঠোঁটে লালাভরা একটা জিভ অনুভব করি। সেদিন থেকে আমি এই ধরণের সমকামী লোকগুলোকে সহ্য করতে পারিনা।দেখলেই রাগে জ্বলতে থাকি। ইচ্ছা করে গলা টিপে মেরে ফেলি। তুই আমায় যা ইচ্ছা ভাবতে পারিস।হয়ত এরপর তুই আমাকে ঘেন্না করবি, যোগাযোগ বন্ধ করে দিবি। কিন্তু আমার সত্যিই কিছু করার নেই রে। “ একটানা এতগুলো কথা বলে পলাশ হাঁফাতে থাকে। শ্রেয়া ফোনের ওপারে কান্নার আভাস পায়। 



শ্রেয়া একটু সময় দেয় পলাশকে। অনেকদিনের জমা ব্যাথা যেন ঝর্ণা হয়ে বেড়িয়ে আসছে। তাকে আটকায় না শ্রেয়া। মনে মনে ভাবে, কে বলে পুরুষের যন্ত্রণা হয় না? পুরুষের অনুভূতি নেই? পুরুষ অসংবেদনশীল? পুরুষ হলেও মানুষ তো। যন্ত্রণায় সেও কুঁকড়ে যায়।বরং আজ যেন মনে মনে স্বীকার করে নেয় শ্রেয়া যে পুরুষের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা নারীর তুলনায় অনেক বেশি।হৃদয়ের রক্তক্ষরন সে লুকিয়ে ফেলতে পারে। ব্যাথা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েও সে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারে। কে বলবে এতদিন যে ছেলেটাকে সে হাসিখুশি প্রানবন্ত বলে জেনে এসেছে সে নিজের মনের গভীরে এত বড় একটা ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে? যে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই করে বাঁচছে? কেন আমরা ভুলে যাই যে পুরুষও মানুষ। মানুষের যাবতীয় অনুভূতিগুলো তাঁদেরও আছে। শুধু প্রকাশের ভাষা আলাদা। মেয়েদের মত তাঁরা সব কিছু খুলে প্রকাশ করতে পারেনা, কারণ সমাজ তাঁদের দুর্বলতা সহ্য করতে পারেনা। সমাজের চোখে নিজেকে শক্ত সমর্থ বলশালী প্রমানের তাগিদে বহু পুরুষ এইভাবেই নিজেদের কষ্ট গিলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বেঁচে থাকেন।

শ্রেয়ার চিন্তাজাল ছিন্ন হয় পলাশ কান্নাভেজা গলার কথায়। শ্রেয়া শুনতে পায় পলাশ বলছে, “ তুই আর কথা বলবি না আমার সাথে, তাই না? সেটাই ভাবছিস ? ঘেন্না হল আমাকে? কাপুরুষ ভাবছিস? কেন কিছু করতে পারিনি বা কাউকে বলতে পারিনি আজও? পারিনি রে।সাহস বল লজ্জা বল বা মামার কাছে কৃতজ্ঞতা বল আমার গলা আটকে রেখেছে। তোকেই  প্রথম বলে ফেললাম।কেন জানিনা মনে হল তুই বুঝবি।আর যাই করিস ঘেন্না করিস না রে আমাকে।কি ভাবছিস বলবি না? শ্রেয়া?”

শ্রেয়া উত্তর দেয় “হ্যাঁ ভাবছিলাম। ভাবছি পরের সপ্তাহে আমি কলকাতায় যাব।বাবা মাকে নিয়ে তোদের বাড়ি যাবো। আমাদের বিয়ের জন্য তোর মায়ের সাথে তো কথা বলা দরকার। নাকি? আমাকে বিয়ে করবি তো নাকি? দয়া করে বলিস না তোকে দয়া করে বিয়ে করতে চাইছি। আমি আমার প্রিয়তম বন্ধুটাকে আর কষ্টে থাকতে দিতে পারছিনা। এখন উপায় নেই তাই। নাহলে ফোনের ভিতর দিয়েই তোর কাছে চলে যেতাম। তোর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলতাম তোর কোনো দোষ নেই পলাশ। দোষ সেই লোকটার যে এই নোংরা কাজটা করেছে।তোকে এখন খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে  রে। ”

এই রকম অদ্ভুত উত্তর শুনে পলাশ হতবাক হয়ে যায়। ও নিজেই অনেকদিন ধরে এই প্রস্তাব দিতে চাইছিল। ভেবেছিল শ্রেয়া কলকাতায় এলে এটাই করবে। কি করে বুঝে নিল মেয়েটা মনের কথাটা। পলাশের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। শ্রেয়া বুঝতে পেরে বলে, “আজ যত ইচ্ছা কেঁদে নে পলাশ। আমার কাছে যত ইচ্ছা কেঁদে নে। সারারাত আমি তোর কান্না শুনতে পারি আজ। কিন্তু কাল থেকে এক ফোঁটা জলও এই কারণে ফেলবি না। তোর কি দোষ? তুই কেন কষ্ট পাবি? যার দোষ সে কর্মফল ভোগ করবেই। আর হ্যাঁ আমি তোকে দুর্বল, কাপুরুষ বা কেন কাউকে কিছু বলিসনি, কেন কিছু আটকাতে পারিসনি – এই সব কিছুই ভাবিনি, ভাবছিও না।কোনোদীনও এইসব কিছুই ভাববো ও না। তোর বিশ্বাসের মর্যাদা দেব। কিন্তু কথা দে এরপর যেদিন তুই ওই লোকটার মুখোমুখি হবি সেদিন আর ভয় পাবি না। যোগ্য জবাব দিবি। প্রতিবাদ তোকে করতেই হবে। তবেই আমি তোদের বাড়ি যাব। কিরে রাজী?কথা দিবি?“

এক সপ্তাহ পর শ্রেয়া নিজের বাবা মাকে নিয়ে পলাশদের বাড়ি উপস্থিত হয়। পলাশের গুরুজন ও শুভানুধ্যায়ীরূপে পলাশের মামাও সপরিবারে উপস্থিত।শ্রেয়ার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় সম্রাটের সাথেও পরিচয় হয়। সম্রাট একগাল হেসে একটা হাত বাড়িয়ে পলাশকে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে আসে।শ্রেয়া দ্রুত পলাশের পিঠের দিকে জামাটা মুঠো করে চেপে ধরে।হঠাৎ পলাশ একটা হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনে উন্মুখ সম্রাটের উন্মুক্ত হাতের একটা হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। সম্রাটের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলে ওঠে,”আর নয় সম্রাটদা। অনেক অত্যাচার করেছিস তুই। আমিও অনেক সহ্য করে গেছি মামার মুখের দিকে তাকিয়ে। নিজেকে বদলা এবার। তোর চাহিদা ভিন্ন হতেই পারে। নিজের মত কাউকে খুঁজে নে। অসহায় নিরপরাধ কাউকে দিয়ে নিজের চাহিদা মেটানোটা এবার বন্ধ কর।নাহলে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। তখন আর মামার কৃতজ্ঞতাও আমাকে আটকাবে না। আর না। এবার শেষ।“

সবাই স্তম্ভিত হয়ে শোনে পলাশের কথা। সম্রাট লজ্জায় মাথা নামিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। পলাশ নতমস্তক মামার কাছে গিয়ে মামার হাত ধরে বলে,”তুমি লজ্জা পাবে কেন মামা। তোমার কিসের লজ্জা। আমায় ক্ষমা কর।কিন্তু আজও যদি না আটকাতাম আমি যে নতুন জীবনটাই শুরু করতে পারতাম না।“ পলাশের মামা কথা বলেন না। শুধু পলাশের মাথাটা দু’হাতে ধরে পলাশের ঘন চুলের মধ্যে মুখ নামিয়ে দেন। যেন পলাশের সব যন্ত্রণা নিজে নিয়ে নিতে থাকেন। সবার চোখেই আজ জল। চোখে জল শুধু কষ্টই বয়ে আনেনা। আনন্দও বয়ে আনে।

 আজ পলাশ মুক্তি লাভ করে এক দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা থেকে। আজ পলাশ নিশ্চিন্তে ঘুমাবে।আর কোনও দিনও পলাশকে ঘুমের মাঝে আঁতকে উঠতে হবেনা। এই ভাবতে ভাবতে শ্রেয়ার মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। পলাশও শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে সেই হাসিতে যোগ দেয়।    

 

 চিত্র সৌজন্যঃ গুগল 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

আপনার বক্তব্য